ড. কে. এম. খালেকুজ্জামান, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: পান চাষে সাধারণত গাছের গোড়া পচা, পাতা পচা রোগ বেশি দেখা যায়। হয়ত পানের বরজে পান পাতা পচে যাচ্ছে তার সমাধান খুঁজে পাচ্ছেন না। এজন্য পান চাষের জমি উঁচু ও দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। বরজের আশপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়া উচিত। এছাড়া আরো কিছু করনীয় আছে, জেনে নিন।

এ রোগে ছাই ও নিমপাতার পানি স্প্রে করে ক্ষতি অনেক কমিয়ে আনা যায়। এছাড়া পচন রোধে রিডোমিল গোল্ড অথবা ডাইথেন এম-৪৫ ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় আক্রান্ত গাছে প্রয়োগ করতে হবে। পান চাষে নিয়মিত ১% বোর্দ্রো মিশ্রণ ১৫ দিন পর পর গাছে স্প্রে করলে সব রোগের উপশম হয়।

১. রোগের নাম : কাণ্ড পচা/গোড়া পচা (Stem rot/Collar rot/Foot rot)
রোগের কারণ : স্ক্লেরোসিয়াম রফসি (Sclerotium rolfsii) নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তার : ছত্রাকগুলো প্রধানত মাটি বাহিত এবং অন্যান্য শস্য আক্রমণ করে। মাটিতে জৈব সার বেশি ও খড়কুটা থাকলে এবং পানি সেচের মাধ্যমে আক্রান্ত ফসলের জমি হতে সুস্থ ফসলের মাঠে বিস্তার লাভ করে।

পড়তে পারেন: সপ্তাহে ৪ কোটি টাকার পান বিক্রি, বিঘায় ৫ লাখ!

রোগের লক্ষণ :
গাছের যে কোনো বয়সে এ রোগ হতে পারে।
গ্রীষ্মকালে মাটির ওপর শায়িত লতায় এ রোগ হয়। গাছের গোড়ায় আক্রমণ করে। গোড়ায় লক্ষ করলে দেখা যাবে মাটির কাছের একটি বা দুটি পর্ব মধ্য কালো বর্ণ ধারণ করেছে। উপরে লতার পাতা হলুদ হয়ে যায় ও ঝড়ে পড়ে। মাটি সংলগ্ন লতার ওপর সাদা সুতার মতো ছত্রাক মাইসেলিয়া দেখা যায়। পরে হালকা বাদামি থেকে বাদামি সরিষার ন্যায় এক প্রকার অসংখ্য দানার মতো স্কে¬রোাসিয়া দেখা যায়। মাটি সংলগ্ন ডাঁটা পচে যায় এবং গাছ ঢলে পড়ে মরে যায়।

রোগের প্রতিকার :
রোগাক্রান্ত লতা-পাতা বরজ থেকে তুলে পুড়ে ফেলতে হবে। রোগ প্রতিরোধী পানের জাত ব্যবহার করতে হবে। গভীর ভাবে জমি চাষ দিয়ে রোদ্রে ভালো করে শুকিয়ে নিতে হবে। নতুন বরজ তৈরির ক্ষেত্রে সুস্থ সবল রোগমুক্ত পানের লতা সংগ্রহ করতে হবে।

পানের বরজ সবসময় আগাছা মুক্ত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ট্রাইকোডারমা কম্পোস্ট সার প্রতি গাছে ৫ গ্রাম হারে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। লতা রোপণের পূর্বে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে প্রোভেক্স বা ব্যভিস্টিন দ্বারা লতা শোধন করে নিতে হবে। বরজে রোগ দেখা দিলে প্রোভেক্স বা ব্যভিস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় মাটিতে স্প্রে করতে হবে।

পড়তে পারেন: পান চাষে লাভবান চারঘাটের সারোয়ার

২. রোগের নাম : শিকড় পচা (Root rot)
রোগের কারণ : রাইজোকটোনিয়া সোলানি (Rhizoctonia solani) নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তার : মাটি, ফসলের পরিতক্ত অংশ ও পানির মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে।

রোগের লক্ষণ :
গাছের শিকড়সহ মাটির নিচের সব অংশই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। প্রাথমিক অবস্থায় পাতা মলিন হয়ে ঢলে পড়ে। পরে লতা ঈষৎ বিবর্ণ হয়ে মরে যায়। এ অবস্থায় শিকড় লাল বর্ণ দেখায় এবং ভেঙে ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়ে যায়।

রোগের প্রতিকার :
সম্ভব হলে মাটি শোধন করতে হবে। রোগাক্রান্ত লতা-পাতা বরজ থেকে তুলে পুড়ে ফেলতে হবে। রোগ প্রতিরোধী পানের জাত ব্যবহার করতে হবে। নতুন বরজ তৈরির ক্ষেত্রে সুস্থ সবল রোগমুক্ত পানের লতা সংগ্রহ করতে হবে। পানের বরজ সবসময় আগাছা মুক্ত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। লতা রোপণের পূর্বে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে প্রোভেক্স বা ব্যভিস্টিন দ্বারা লতা শোধন করে নিতে হবে। বরজে রোগ দেখা দিলে প্রোভেক্স বা ব্যভিস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় মাটিতে স্প্রে করতে হবে।

পড়তে পারেন: পানের পাতা পচা রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার

৩. রোগের নাম : ঢলে পড়া (Wilt)
রোগের কারণ : ফিউজারিয়াম অক্সিস্পোরাম (Fusarium oxysporum) নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তার : ছত্রাকগুলো প্রধানত মাটি বাহিত এবং অন্যান্য শস্য আক্রমণ করে এবং পানি সেচের মাধ্যমে আক্রান্ত ফসলের জমি হতে সুস্থ ফসলের মাঠে বিস্তার লাভ করে।

রোগের লক্ষণ :
গাছের গোড়ায় আক্রমণ করে। গাছের উপরের পাতা হলুদ হয়ে যায়। কাণ্ডের ভাস্কুলার টিস্যু আক্রমণ করে। গোড়ার দিকে কাণ্ড লম্বালম্বিভাবে ফাটালে ভেতরে দাগ দেখা যায়। পরে গাছ ঢলে পড়ে। আক্রমণ বেশি হলে গাছ মরে যায়।

রোগের প্রতিকার :
রোগাক্রান্ত গাছ তুলে এবং ফসল সংগ্রহের পর পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। গাছের গোড়ার চতুর্দিকের পৃষ্ঠের মাটি নেড়ে শুষ্ক করে দিলে এ রোগ অনেকাংশে দমন হয়। লতা রোপণের পূর্বে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে প্রোভেক্স বা ব্যভিস্টিন দ্বারা লতা শোধন করে নিতে হবে। রোগ দেখা দিলে প্রোভেক্স বা ব্যভিস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় মাটিতে স্প্রে করতে হবে।

পড়তে পারেন: বেড়েছে পানের দাম, স্বস্তিতে রাজশাহীর চাষিরা

৪. রোগের নাম : গোড়া-লতা ও পাতা পচা (Foot rot/vine rot and leaf rot)
রোগের কারণ : ফাইটোফথোরা প্যারাসাইটিকা (Phytophthora parasitica) নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তার : কম ম্যাগনেসিয়াম ও বেশি লবণাক্ত মাটিতে রোগের প্রকোপ বেশি। অবিরত বৃষ্টিপাত হলে এবং আর্দ্র আবহাওয়ায় এ রোগ বিস্তার লাভ করে।

রোগের লক্ষণ :
প্রাথমিক অবস্থায় পাতায় পানি ভেজা হলুদাভ বাদামি রঙের দাগ দেখা যায়। ধীরে ধীরে দাগ বিস্তৃত হয়ে বড় হতে থাকে। দাগ পাতার কিনারা হতেও শুরু হতে পারে। অবিরত বৃষ্টিপাত স্থলে রোগটি পাতা হতে বোঁটায় এবং লতায় সংক্রমিত হয়।
আক্রান্ত পাতা ও লতায় এক প্রকার কালো দাগ পড়ে। ওই দাগের মাঝখানে বিবর্ণ হয়ে পচে যায়। আক্রান্ত পাতা ঝরে পড়ে। পরে গাছের শিকড়, লতা ও পাতা পচে এক প্রকার দুর্গন্ধ নির্গত করে। আক্রমণ বেশি হলে গাছ মারা যায়।

রোগের প্রতিকার :
রোগাক্রান্ত গাছের পাতা তুলে পুড়ে ফেলতে হবে। রোগমুক্ত লতা বীজ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। রোগ প্রতিরোধী জাত বারি পান-২ চাষ করতে হবে। ঘন ঘন সেচ প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ট্রাইকোডার্মা জীবাণু সার ৫ গ্রাম হারে প্রতি গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করতে হবে। বরজে রোগ দেখা দিলে রিডোমিল গোল্ড অথবা কমপেনিয়ন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছের গোড়াসহ সব গাছে ১০ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার ¯েপ্র করতে হবে।

ড. কে. এম. খালেকুজ্জামান ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব), মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, শিবগঞ্জ, বগুড়া।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ