পুঠিয়া (রাজশাহী) প্রতিনিধি: রাজশাহীর পুঠিয়ায় রাত নামলেই ফসলী জমিগুলোতে অবৈধ পুকুর খননের হিড়িক পড়ে যায়। এ কর্মকান্ড কিছুতেই বন্ধ করতে পারছে না স্থানীয় প্রশাসন। ফলে বর্ষা মৌসুমে মাত্রাতিরিক্ত জলাবদ্ধতার কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।

স্থানীয় এলাকাবাসী লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোনো সুফল পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। অপরদিকে পুকুরের মাটি ইটভাটায় সরবরাহ করতে গ্রামীন সড়ক গুলোতে সারারাত দাপিয়ে চলছে ড্রামট্রাক ও অবৈধ ট্র্যক্টর।

জানা গেছে, কৃষি জমিতে পুকুর খনন বন্ধ করতে গত দু’বছর আগে জনস্বার্থে মহামান্য হাইকোর্টে ২৪৭৬/২০১৯ নম্বরে একটি রীট আবেদন করা হয়। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত গত ২০১৯ সালে কৃষি জমির শ্রেণী পরিবর্তন বা পুকুর খনন না করতে আদেশ দেন। পাশাপাশি কোথাও পুকুর খনন কাজ চললে উপজেলা প্রশাসনকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু আদালতের নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করে রাতের আধাঁরে পুকুর খনন কাজ শুরু করছেন মৎস্য ব্যবসায়িরা।

উপজেলা সদরের কাঠালবাড়িয়া গ্রামের নয়ন মোল্লা বলেন, পরীগাছা-বারইপাড়া এলাকায় ফসলী জমিতে রাতের আধাঁরে একটি দীঘি খনন করা হচ্ছে। আর ওই দিঘীর মাটি প্রতিদিন রাত ৮ টা থেকে সকাল ৭ টা পর্যন্ত ড্রাম ট্রাকে করে ইটভাটার মালিকরা নিচ্ছে। অতিরিক্ত মাটি বহণের কারণে আমাদের এই সড়ক ভেঙ্গে গেছে। পাশাপাশি সারারাত গাড়ীর শব্দের কারণে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। বিষয়টি লিখিত ভাবে উপজেলা প্রশাসনকে অভিযোগ দিলেও তিনি রহস্যজনত কারণে নিরবতায় রয়েছেন।

শিলমাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেন মকুল বলেন, পুকুর খননের বিষয়টি উপজেলা আইন শৃংখলা ও মাসিক সভায় আলোচনা করেও কোনো লাভ হয়নি। বরং পুকুর মালিকরা একটি বড় মহলকে ম্যানেজ করে তাদের খনন কাজ অব্যাহত রেখেছেন। পুকুর ও ড্রামট্রাক-ট্র্যক্টর মালিকদের কারণে গ্রামীন সড়ক গুলোর চলচলের অনুপযোগি হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে এই ইউপি এলাকায় ফসলী জমির চেয়ে পুকুরের জমি বেশী। এখনো ১০-১২ স্থানে খনন কাজ চলছে। এর মধ্যে যাদের আদালতের কাগজপত্র আছে তারা দিনে আর বাকিরা গভীররাতে খনন করছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শামসুন নাহার ভূইয়া বলেন, এখানে পুকুর খনন বিষয়ে কেউ আইন বা নির্দেশনা মানছে না। যার যেখানে ইচ্ছে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে পুকুর খনন করছেন। এতে করে এই অঞ্চলের ফসলী জমি দ্রুত কমে যাচ্ছে। আবার বর্ষা মৌসুমে মাত্রাতিরিক্ত জলাবদ্ধতার কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।

এ বিষেয়ে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রোমানা আফরোজ বলেন, উপজেলায় নতুন করে কি পরিমাণ জমিতে পুকুর খনন হয়েছে বা হচ্ছে তার সঠিক পরিসংখ্যান এখনো হয়নি। তবে আমাদের ইউনিয়ন ভূমি অফিস গুলো ও সার্ভেয়ারকে বিষয়টি তদারকি করতে বলা হয়েছে।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুল হাই মোহাম্মদ আনাছ বলেন, পুকুর খনন রোধে এলাকার লোকজনদের সচেতন করতে আমরা সভা সমাবেশ করেও তা রোধ করতে পারছি না। জমির মালিকরা অতিরিক্ত অর্থের লোভে পুকুর চাষিদের কাছে জমি দিয়ে দিচ্ছে। এরপর পুকুর চাষিরা স্থানীয় প্রভাবশালী একটি মহলের মদদে গভীররাতে ফসলী জমিতে পুকুর করছে।

আবার অনেকে পুকুর খনন করতে আদালতের নির্দেশনা আনছেন। যার কারণে আমাদের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও খনন বন্ধে কোনো প্রকার পদক্ষেপ নিতে পারছি না। তবে এলাকার ফসলী জমি রক্ষার্থে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষকে প্রতিবাদ করতে হবে। আর রাতের আধাঁরে গ্রামীণ সড়ক গুলোতে দাপিয়ে চলা ড্রামট্রাক ও ট্র্যক্টর প্রতিরোধে আমরা মাঝে মধ্যে অভিযান চালাচ্ছি। তাদের জেল-জরিমানাও করা হচ্ছে।

বাঘায় চলছে পুকুর খননের মহাউৎসব, কৃষকের মাথায় হাত

রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খনন চলছে। এ বিষয়ে স্থানীয়রা বিভিন্ন স্থানে অভিযোগ করেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছেনা। এসব জমিতে কৃষকরা বিভিন্ন ফসল ফলাতেন। কিন্তু পুকুর খনননের কারনে ফসল ফলাতে না পেরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

জানা গেছে, বাঘা উপজেলার বাউসা ইউনিয়নের মধ্যে মাঝপাড়া, দিঘার চুনির বিল, কামারপাড়া বিল, পীরগাছা ও মনিগ্রাম ইউনিয়নের হেলালপুর, কলাবাড়িয়া, হাবাসপুর এবং বাজুবাঘা ইউনিয়নের হিজলপল্লী, বারখাদিয়া, নওটিকা এলাকায় ভেকু দিয়ে ব্যাপকহারে কাটা হচ্ছে পুকুর। এই সব এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে অসংখ্য পুকুর খনন করা হচ্ছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে বিলে বিভিন্ন উৎপাদিত ফসলি জমিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। পুকুর খননে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে প্রায় ৫০ হাজার বিঘা জমিতে আবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে পুকুর কাটার কারনে শত শত বিঘা জমিতে রোপন করা আম গাছের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

গত ৩-৪ বছর ধরে পুকুর খননের কারণে এলাকার কৃষকরা ফসল ফলাতে পারছেন না। যেসব জমিতে বিগত সময়ে এক বছরে তিন ধরনের ফসল উৎপাদন হতো। বর্তমানে কোনো মৌসুমে ফসল ফলাতে পারছেন না কৃষকরা। ফলে শত শত কৃষক মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

বাউসা গ্রামের রতন কুমার, বারখাদিয়া গ্রামের রবিউল ইসলাম, জোতরাঘব গ্রামের চঞ্চল মাহমুদ জানান, বর্তমানে উপজেলার বিভিন্ন বিলগুলোতে যেভাবে পুকুর খনন করা হচ্ছে, তাতে দুই/তিন বছরের মধ্যে আর কোন ফসলি জমি থাকবে না। এদিকে বর্ষা মৌসুমের জন্য পদ্মা নদীর সঙ্গে ড্রেন করে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা দরকার। পুকুর খননের কারনে অনেক সমস্যায় পড়ছে এলাকার সাধারণ মানুষ। আসঙ্কাজনক হারে কমছে ফসলি জমি।

মনিগ্রাম ইউনিয়নের হাবাসপুর গ্রামের অসিত কুমার জানান, আমার আগের পুকুর মেরামত করেছি। তবে ইতিমধ্যে সেটা কাটা হয়ে গেছে। তবে নতুন করে কোন পুকুর খনন করা হচ্ছে না। স্থানীয়দের দাবি তিনি নতুনভাবে ১১ বিঘা ফসলী জমিতে পুকুর খননের কাজ করছেন।

এদিকে তেথুলিয়া গ্রামের অচিত তলা বিলে পুকুর খননকারি জামাল উদ্দিন বলেন, আমার নিচু জমিতে ফসল হয় না। তাই পুকুর খনন করছি। ভেকু না পাওয়ার কারনে চার বিঘার মধ্যে একটি মাত্র পাড় শুধু বাধা হয়েছে।

বাউসা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান শফিক বলেন, পুকুর খনন চলছে শুনেছি। বিষয়টি প্রশাসনকে অবগত করা হয়েছে।

বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লাহ সুলতান বলেন, পুকুর খনের বিষয়টি জেনেছি। আগামী মাসের মাসিক সমন্বয় সভায় উপস্থাপনা করা হবে।

এ বিষয়ে বাঘা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পাপিয়া সুলতানা বলেন, যেখানে পুকুর খনন হচ্ছে, সেখানে গিয়ে অভিযান চালিয়ে ভেকু সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। আর যে সকল এলাকায় আরো নতুনভাবে পুকুর খনন চলছে, সেই এলাকায় অভিযান চালানো হবে এবং পুকুর খননকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ