আবু খালিদ, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম:  গত কয়েক বছর ধরে এক হাজার ব্রয়লার মুরগি নিয়ে খামার পরিচালনা করে বেশ ভালই চলছিলো খামারি ইউসুফ আলীর। কিন্তু চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যান তিনি।

অতিরিক্ত গরমে প্রায় ৮০ ভাগ মুরগি মারা যায় তার। মুরগিগুলোর বয়স হয়েছিলো ২০ দিন। যেন নিমিষেই সব হারিয়ে নি:স্ব হয়ে যান তৃণমূলের এ খামারি। বিষয়টি গবেষকদের আলোকপাত করা হলে তারা বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তন অর্থাৎ আবহাওয়াগত পরিবর্তনের প্রভাবের নমুনা এটি।

গাজীপুরের পোল্ট্রি খামারি ইউসুফ জানান, এর আগে অধিক তাপমাত্রায় তার খামারে প্রভাব পড়েছে। কিন্তু এবারের প্রভাবটি ছিলো খুবই মারাত্মক। সব শেষ করে দিয়েছে।

জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে ইউসুফ আলীর মতো অনেক খামারিই সব হারিয়ে নি:স্ব হয়ে যাচ্ছেন। বছরের পর বছর এমন সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলা বা প্রতিরোধে সরকারি ও বেসরকারিভাবে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না।

পোল্ট্রি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধতন কর্মকর্তা ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সাথে আলাপকালে জানা গেলো পোল্ট্রি শিল্পে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলার উদ্যোগ গ্রহণ এখনো শূন্যের কোঠাতেই রয়েছে।

এ শিল্পে গত কয়েকবছরে জলবায়ুর পরিবর্তনের আঘাত তীব্রতর হয়েছে বলে এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে জানিয়েছেন, পোল্ট্রি শিল্পের ওপর জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করে আসা অধ্যাপক ড. সচ্চিদানন্দ দাস চৌধুরী।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোল্ট্রি সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. সচ্চিদানন্দ দাস চৌধুরী এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, জলবায়ুর প্রভাব ২০০০ সালের পর থেকেই পোল্ট্রি শিল্পে তীব্রতর হতে শুরু করেছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে এর ব্যাপকতা। কিছু কিছু এলাকায় তো তীব্রতর হচ্ছে।

পোল্ট্রি শিল্পে জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলায় আমরা কতটুকু প্রস্তুত। উত্তরে পোল্ট্রি এ গবেষক বলেন, উদ্যোগ তো দূরের কথা আমাদের প্রস্তুতিই একেবারে শূন্যের কোঠায়। অনেকগুলো পদক্ষেপ নেয়ার থাকলেও এখনো একটিও নেয়া হয় নি।

গবেষক ড. সচ্চিদানন্দ দাস চৌধুরীর নেতৃত্বে স্বল্প পরিসরের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, পোল্ট্রি শিল্পে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলছে উচ্চ তাপমাত্রা।

গবেষণায় পাওয়া গেছে, উচ্চতাপমাত্রার কারণে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মুরগি মারা গেছে, গ্রোথ কমেছে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ এবং ডিমের উৎপাদনও কমেছে। এছাড়া মুরগির হজম শক্তি হ্রাস, অরুচি বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে গেছে।

দেশজুড়ে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে এমন পরিসংখ্যানও নেই বলে জানান ওই গবেষক। এসব ক্ষয়ক্ষতিসহ প্রভাবের পরিমাণটা নির্ণয় করে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কী কোন পদক্ষেপ নিয়েছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রাণিসম্পদ-২) কাজী ওয়াছি উদ্দিন এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, না এখনো সরাসরি কোন পদক্ষেপ নেয়া হয় নি। তবে কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে গবেষণার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

এ বিষয় নিয়ে কেউ কাজ করতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সাপোর্ট দেয়া হবে বলে মন্তব্য করেন মন্ত্রণালয়ের প্রাণিসম্পদ খাতের দায়িত্বে থাকা ঊর্ধতন এ কর্মকর্তা।

পোল্ট্রি গবেষক ড. সচ্চিদানন্দ দাস চৌধুরী বলেন, কৃষি ও পোল্ট্রি শিল্পে একই সাথে জলবায়ুর প্রভাব পরা শুরু করেছে। কিন্তু দেখবেন কৃষিতে জলবায়ু সহিঞ্চু, খরা ও বন্যা সহিঞ্চু এরকম নানা জাত উদ্ভাবন হয়েছে এবং চলামানও রয়েছে। কিন্তু পোল্ট্রি শিল্পে সেটা এখনো সেভাবে ‍শুরু হয় নি।

‘তবে সবকিছু মেইনটেইন করে ক্ষতিটি কত কমানো যায় সেটা নিয়ে অল্প বিস্তর কাজ করছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।’

জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় কী কী বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া দরকার এমন প্রশ্নের উত্তরে এ গবেষক বলেন, প্রচুর গবেষণা, খামারিসহ সবাইকে প্রশিক্ষণ দেয়া, উচ্চ তাপমাত্রা ও আমাদের দেশের আবহাওয়া সহিঞ্চু জাত উদ্ভাবন, খামার ব্যবস্থাপনায় খুবই গুরুত্ব দিতে হবে।

এছাড়া খাবারের মাধ্যমে পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা গবেষণায় দেখেছি যে, পরিকল্পিতভাবে খাবার দিলে ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব। যেমন; গরমের সময়ে স্যালাইন ব্যবহার করে অনেক সুফল মিলেছে। কিন্তু এগুলোর ব্যবহার সঠিক পদ্ধতিতে করতে হবে।

এ বিষয়ে পোল্ট্রি সংগঠক ও বর্তমানে ওয়ার্ল্ড পোল্ট্রি সায়েন্স এ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ শাখা এর সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. আলী ইমাম এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, জলবায়ুর প্রভাবে ক্ষতির পরিমাণ দৃশ্যমান হলেও এ বিষয়ে সঠিক পরিসংখ্যান বা গবেষণা নেই। জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলার প্রস্তুতি ও উদ্যোগ এখনো সে অর্থে নেয়া শুরু হয় নি। ইস্যু হিসেবে নিয়ে কাজ শুরু করা জরুরি।