নিজস্ব প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে প্রাথমিক স্বীকৃতি পেয়েছে ফজলি আম। এর আগে, রাজশাহী জেলার ফজলি আমকে ‘রাজশাহীর ফজলি’ নামে স্বীকৃতি দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদফতর। পরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের আপত্তির প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার (২৪ মে) ‘রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি’ নামে ফজলি আমের জিআই স্বত্ত্ব ঘোষণা করা হয়েছে।

জানা গেছে, ২০১৭ সালে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার ফজলি আমকে ‘রাজশাহীর ফজলি’ নামে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করে রাজশাহী ফল গবেষেণা কেন্দ্র। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বাঘার ফজলি আমকে রাজশাহীর ফজলি নামে জিওগ্রাাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন (জিআই) বা ভৌগলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি দিয়ে জার্নাল প্রকাশ করা হয়।

জিআই পণ্যের স্বীকৃতির নিয়মানুযায়ী জার্নালে প্রকাশের দুই মাসের মধ্যে আপত্তি জানানোর নিয়ম থাকায় সিন্ধান্তের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসীর পক্ষে আবেদন করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশন। আপত্তির যৌক্তিকতা বিবেচনা করে মঙ্গলবার (২৪ মে) সকালে ঢাকায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদফতর মিলনায়তনে উভয় পক্ষের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।

পড়তে পারেন: জিআই স্বীকৃতি পাচ্ছে বাংলাদেশের ফজলি আম ও চিংড়ি

শুনানি শেষে বিকেলে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক বিভাগের রেজিস্ট্রার যোগেন্দ্র নাথ সরকারের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের জুরি বোর্ড ফজলি আমকে ‘রাজশাহীর ফজলি’র পরিবর্তে ‘রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম’ হিসেবে প্রাথমিক স্বীকৃতির ঘোষণা দেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আমের জিআই স্বীকৃতির বিষয়ে সোচ্চার সিনিয়র সাংবাদিক সামসুল ইসলাম টুকু জানান, ফজলী আমের জিআই স্বীকৃতির দাবিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আম বাগান মালিক, আম ব্যবসায়ী, চেম্বার অফ কমার্স, সুশীল সমাজ ও সাংবাদিকসহ জেলার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ কয়েক মাস ধরে আন্দোলন করে আসছেন।

তিনি আরও বলেন, জাতীয় এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আম বলতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমকেই বোঝায়। এছাড়া কয়েক বছর আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাকে ‘আমের রাজধানী’ ঘোষণা করেছে সরকার।

পড়তে পারেন: ফজলি আমের স্বীকৃতির দাবিতে মানববন্ধন

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আমের ইতিহাস বর্ণনা করে তিনি বলেন, ১৮০০ সালের দিকে চাপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত সংলগ্ন গৌড়ে ফজল বিবি নামে এক বৃদ্ধা বাস করতেন। সে সময় মালদহ জেলার একজন ইংরেজ কালেক্টর সরকারী কাজে গৌড়ে আসেন এবং সেখানে শিবির স্থাপন করেন।

কালেক্টরের আসার কথা শুনে ফজল বিবি উপঢৌকন হিসেবে তারই বাড়ির আঙ্গিনার আমগাছের আম উপহার আনেন। কালেক্টর আম খেয়ে তৃপ্ত হয়ে বৃদ্ধাকে সেই আমের নাম জিজ্ঞেস করেন। বৃদ্ধা কালেক্টরের ভাষা বুঝতে না পেরে আমের জায়গায় তার নিজের নাম বলেন ‘ফজলি বিবি’। সেই থেকে আমটির নামকরণ হয় ‘ফজলি’। রাজশাহীতে ফজলী বা অন্য কোনো আমের ঐতিহাসিক স্বীকৃতি নেই। সুতরাং, ফজলি আম যে শুধুমাত্র চাঁপাইনবাবগঞ্জেরই ভৌগলিক পণ্য সেটা প্রমাণিত।

স্থানীয় কৃষি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় প্রতি বছর ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় সোয়া তিন লক্ষ টন আম উৎপাদিত হয়। যার শতকরা ২৩ ভাগ বা ৭৫ হাজার টন ফজলি আম। রাজশাহী জেলায় প্রতি বছর ফজলি আম উৎপাদন হয় ২৮ হাজার টন।

পড়তে পারেন: রাজশাহীতে ফজলি আমের দরপতন, মণ সাড়ে ৫’শ

ইতিহাস গবেষক ও লেখক জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, সে সময় ব্রিটিশ লেখক ড. বুকানন হ্যামিলটন ১৮০৮ সালে মালদাহ অঞ্চলের আমের ভূয়সী প্রশংসা করেন, যা বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থেও উল্লেখ আছে। উইকিপিডিয়াতেও একই তথ্য উল্লেখ করা রয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী তৎকালীন গৌড় বা ব্রিটিশ ভারতের দক্ষিণ মালদহের পুরোটা জুড়ে ছিল বড় বড় আম বাগান। সেই দক্ষিণ মালদহই বর্তমানের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা।

তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার পরও আমরা দেখেছি ঢাকার পাইকারী ব্যবসায়ীরা ৪০০-৫০০ মণের নৌকা নিয়ে বারঘরিয়া, রহনপুর, ভোলাহাটের আমের মোকাম থেকে আম নিয়ে যেতো। তখন তাদের ঢাকুয়ালের নৌকা বলা হতো। এখনও সদরঘাট, কানসাট, রহনপুর, ভেলাহাট থেকে শত শত ট্রাকে আম নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যান ব্যবসায়ীরা। সুতরাং, ফজলি আম যে শুধুমাত্র চাঁপাইনবাবগঞ্জেরই তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুনজের আলম মানিক মুঠোফোনে জানান, অনেক লড়াই ও সংগ্রামের পর আমরা ফজলি আমের জিআই স্বীকৃতির অংশীদারিত্ব পেলাম। তবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যগতভাবে ফজলি আম আমাদের পণ্য। কিছু অসামঞ্জস্যতার কারণে সেটি হাতছাড়া হতে চলেছিল। শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদফতর এই ঘোষণাকে প্রাথমিক সিন্ধান্ত হিসেবে জানিয়েছেন।

আগামী রোববার এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করার কথা রয়েছে। এছাড়াও পেটেন্ট বিভাগের সিন্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ রয়েছে। আজ আমরা ঢাকায় আছি। চাঁপাইনবাবগঞ্জে গিয়ে জেলাবাসীর সাথে আলোচনার পর আপিলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। কারণ, আমরা বিশ্বাস করি ফজলি আম শুধুমাত্র চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ