বাগদা চিংড়ির রোগ: নেক্রোটাইজিং হেপাটোপ্যানক্রিয়াটাইটিস বা NHP নিয়ে লিখেছেন অমিতোষ সেন, প্রাক্তন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা, মৎস্য অধিদফতর। NHP বাগদা চিংড়ির একটি ব্যাকটেরিয়া ঘটিত চরম ক্ষতিকর রোগ। ১৯৮৫ সালে আমেরিকার টেক্সাসে এ রোগ প্রথম দেখা যায়। সেখান থেকে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার চিংড়ি খামার সমূহে এবং পরবর্তীতে ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে এ রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

আলফা প্রো-ব্যাকটেরিয়া এই রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী। এইটি একটি গ্রাম-নেগেটিভ, অবলিগেট, অন্ত-কোষীয় ব্যাকটেরিয়া, যা কোন প্রকার প্রচলিত পদ্ধতিতেই গবেষণাগারে কলোনি-চাষ করা যায়না। এই কারনে জীবিত চিংড়ির শরীরে এর গতিপ্রকৃতি নিরীক্ষণ ব্যতীত গবেষণাগারে এই রোগের গবেষণা করা সম্ভব হচ্ছেনা

পানির লবণাক্ততা এবং তাপমাত্রা বেড়ে গেলে এ রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেতে পারে বলে মনে করা হয়। বাগদা সহ পিনিড গোত্রের সব চিংড়ি প্রজাতি এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এই রোগ চিংড়ির জন্য এতই মারাত্মক হতে পারে যে, চিংড়ি সম্পদের ৯৫% পর্যন্ত মৃত্যু ঘটতে পারে।

NHP এর সাধারন লক্ষণ:

১. চিংড়ির অলসতা দেখা দেয় এবং স্বাভাবিক চলাফেরা কমে যায়।
২. চিংড়ির ক্ষুধা কমে যায়, খাদ্য গ্রহণে অনীহা দেখা যায়, ফলে পরিপাকনালী খাদ্যশূণ্য থাকে।
৩ .চিংড়ির স্বাভাবিক বৃদ্ধি কমে গিয়ে শরীর ক্ষীণ হয়ে যেতে পারে।
৪. চিংড়ি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং এক সময় মারা যায়।
৫. হেপাটোপ্যানক্রিয়াস ফ্যাকাসে ও ক্ষীণ হয়ে যায়।
৬. তবে এইসব উপসর্গের কোনটাই চিংড়ির শরীরে NHP-ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের নিশ্চয়তা বহন করেনা। আক্রান্ত বা মৃত চিংড়ির PCR পরীক্ষা করে NHP-ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে, এটাই একমাত্র উপায়।

খামারে NHP সংক্রমণের সম্ভাব্য উপায়:

১. খামারের কর্মী, সরঞ্জাম, জাল, বিভিন্ন প্রাণি, পাখি, গাড়ি, খাদ্য সামগ্রী, অশোধিত পানি ইত্যাদির মাধ্যমে NHP-ব্যাকটেরিয়া বাহির থেকে খামারে প্রবেশ করতে পারে।
২. পিএল এর মাধ্যমে খামারে NHP-ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করার সম্ভাবনাই বেশি।

রোগমুক্ত পিএল সংগ্রহের উপায়:

SPF পিএল এর শরীরে NHP-ব্যাকটেরিয়া যাতে না থাকে, তা হ্যাচারি থেকেই পরীক্ষা করে দেওয়া হয়। তারপরেও পিএল ক্রয়ের সময় চাষিদের নিজ উদ্যোগে পিএল এর PCR পরীক্ষা করা উচিত। কক্সবাজার, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের জেলা মৎস্য অফিস গুলিতে PCR Hand-kit মেশিন আছে। এছাড়া খুলনা এবং চট্টগ্রামে মৎস্য অধিদপ্তরের FIQC Lab সমূহেও এইসব পরীক্ষা করা যায়। কক্সবাজারে ACI কোম্পানির প্রাইভেট ল্যাব আছে। এসব স্থানে চাষিরা ফি দিয়ে চিংড়ির শরীরে জীবাণু পরীক্ষার সেবা গ্রহণ করতে পারেন।

কিছু হ্যাচারি আছে, যারা সাগর থেকে আনা মাদার চিংড়ির PCR পরীক্ষা করে বিভিন্ন রোগজীবাণু মুক্ত পিএল উৎপাদন করে। এসব হ্যাচারিতে আগে থেকে অর্ডার দিয়েও রোগমুক্ত পিএল সংগ্রহ করা যায়। তবে সেই ক্ষেত্রেও পিএল ক্রয়ের সময় এর PCR পরীক্ষা করে রোগজীবাণুর অনুপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।

কিন্তু প্রাকৃতিক উৎসের পিএল, চোরাই পথে আনা পিএল অথবা চোরাই পথে আনা নপলি থেকে উৎপাদিত পিএল এর শরীরে এসব রোগজীবাণু না থাকার কোন নিশ্চয়তা নেই।

প্রতিকার:

চিংড়ি খামারে NHP এর কোনপ্রকার প্রতিকারের ব্যবস্থা নেই। তাই এই রোগ খামারে আসতে না পারে মত প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতে হবে। এরূপ সমন্বিত প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে বলা হয় “বায়ো-সিকিউরিটি”।

NHP প্রতিরোধের পদ্ধতি:

১. কয়েক সপ্তাহব্যাপী পানির তাপমাত্রা এবং লবণাক্ততার বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে সেখানে NHP এর প্রকোপ বেড়ে যেতে পারে। তাই পানির এই দুটি গুণ যেন আদর্শ সীমার মধ্যে থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
২. চাষ শুরু করার আগে পুকুর প্রস্তুতির কাজ ভালোভাবে করতে হবে।
৩. SPF অথবা PCR পরীক্ষা করা পিএল মজুদ করতে হবে। পিএল ক্রয়ের সময়েই PCR পরীক্ষা করে এর শরীরে NHP-ব্যাকটেরিয়ার অনুপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তারপর সেই পিএল খামারে ছাড়তে হবে।
৪. পিএল এর মজুদ ঘনত্ব ঠিক রাখতে হবে।
৫. পুকূরের তলায় পচনশীল জৈব পদার্থ জমতে দেওয়া যাবেনা।
৬. পানির গভীরতা ঠিক রাখতে হবে।
৭. খামারের পানি পরিবর্তন বাদ দিতে হবে (মজুদ ঘনত্ব ঠিক থাকলে খামারের পানি পরিবর্তন না করলে কোন সমস্যা হয়না)।
৮. খামারের কর্মী, সরঞ্জাম, জাল, বিভিন্ন প্রাণি, পাখি, গাড়ি, খাদ্যসামগ্রী, অশোধিত পানি, ভিজিটার ইত্যাদির মাধ্যমে যেন রোগজীবাণু খামারে প্রবেশ করতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে।
৯. খামারের বায়োসিকিউরিটি বজায় রাখতে হবে।

পরিশেষে:
সতর্কতার সাথে চিংড়ি চাষ করুন। খামারের চিংড়িকে রোগমুক্ত রাখুন। জানুন, বুঝুন, অনুধাবন করুন, বিশ্বাস করুন, আস্থার সাথে অনুশীলন করুন এবং অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সফল হোন।

বাগদা চিংড়ির রোগ: নেক্রোটাইজিং হেপাটোপ্যানক্রিয়াটাইটিস বা NHP শিরোনামের লেখাটির লেখক অমিতোষ সেন, প্রাক্তন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা, মৎস্য অধিদফতর।