ফসল ডেস্ক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) গোপালগঞ্জ কৃষি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্প দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল কৃষিতে বদলে গেছে। এ অঞ্চলে বিএআরআই উদ্ভাবিত জাতের ফসলের আবাদে কৃষির উৎপাদন বেড়েছে। ফুল, ফল, সবজি চাষে কৃষকের আর্থ সামাজিক অবস্থা পাল্টে যাচ্ছে।

বিএআরআই উদ্ভাবিত মাল্টা, লেবু, পেয়ারা, আমসহ বিভিন্ন ফলের বাগান এ অঞ্চলে ওই প্রকল্প থেকে স্থাপন করে দেয়া হয়েছে। ফলের বাগান করে অনেক কৃষক স্বাবলম্বী হয়েছেন। এছাড়া কৃষিগবেষণা ইনস্টিটিউটের ওই প্রকল্পের পক্ষ থেকে মাঠ দিবস, কৃষক প্রশিক্ষণ, ফসলের প্রদর্শণী করা হয়েছে।

বিনামূল্যে কৃষকদের বীজ, ফলের চারা, ড্রাম, ত্রিপল, বস্তা, দা, কাঁচি, খুন্তা,নিড়ানী বিতরণ করা হয়েছে। এসব সহায়তা পেয়ে এ অঞ্চলের কৃষক উপকৃত হয়েছেন। তারা ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ির আঙ্গিনায় কৃষি গবেষণার উচ্চ ফলশীল ফলের চারা রোপণ করে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ করছেন।

গত ৪ বছরে এ প্রকল্প থেকে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত সরিষা, তিল, বাদাম, সূর্যমুখী, মুগ, মসুর, মটর, খেসারী, আলু, গম, ভুট্টা, সবজি, কলা, আম, মাল্টা,পেঁয়ারা, লেবু, পেঁয়াজ, রসুন, হলুদ, মৌরি,জাউন,শোলক, ফিরিঙ্গি, কালোজিরা, ধনিয়ার, গ্রীস্মকালীন টমেটো ও মেথিসহ বিভিন্ন জাতের ফসলের উপযোগিতা এ অঞ্চলে গোপালগঞ্জ, খুলনা,সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও পিরোজপুর জেলায় যাচাই করা হচ্ছে।

এর মাধ্যমে প্রকল্পটি এ অঞ্চলের কৃষকের সাথে উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসলের পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছে। তারা এগুলো চাষাবাদের কৌশল রপ্ত করেছে। কৃষক এসব ফসলের বীজ সংরক্ষণ করছেন। পরবর্তী বছর এসব বীজ দিয়ে চাষাবদ করে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করে লাভবান হচ্ছেন।

এগ্রিকেয়ার২৪.কমের আরোও নিউজ পড়তে পারেন:

শ্রাবন মাসে কি কি সবজি চাষ করবেন, জানুন বিস্তারিত

লালমনিরহাটে ৫ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ

কুয়েতের মাটিতে সবজি চাষে সফল বাংলাদেশী প্রবাসীরা

কৃষি মন্ত্রণালয় গোপালগঞ্জ জেলায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন ও দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পরিবেশ প্রতিবেশ উপযোগী গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করণের মাধ্যমে ৫ বছর মেয়াদী কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে।

গোপালগঞ্জ শহরের চাঁদমারী রোডে ভাড়া বাড়িতে এ প্রকল্প ২০১৮ সালে যাত্রা শুরু করে। এখান থেকে ৫ জেলায় কৃষি উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করা হয়। ইতিমধ্যে এ প্রকল্প ৪ বছর অতিক্রম করেছে। আগামী ২০২৩ সালে এ প্রকল্প শেষ হবে।

কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রকল্প পরিচালক ড. এমএম কারুজ্জামান বলেন, গত চার বছরে আমরা ৫ জেলায় ১৫২টি কৃষক প্রশিক্ষণ কর্মশালা করেছি। এতে ব্যয় হয়েছে ৪৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। অরো ৪৫টি কৃষক প্রশিক্ষণ অবশিষ্ট রয়েছে। চলতি অর্থবছরে ১৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা ব্যয়ে কৃষক প্রশিক্ষণ গুলো আমরা সম্পন্ন করব।

৩৯৬টি কৃষক প্রশিক্ষণের জন্য ১ কোটি ৯৫ লাখ ৩২ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে আমরা ১ কোটি ৬২ লাখ ৯৪ হাজার টাকা ব্যয়ে ৩৩২টি কৃষক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছি। অবশিষ্ট ৩২ লাখ ৩৮ হাজার টাকা ব্যয়ে ৬৫ টি কৃষক প্রশিক্ষণ আমরা প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সম্পন্ন করব।

৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে এ অঞ্চলের জন্য উপযোগী ২ হাজারটি প্লটে ফসলের উপযোগিতা যাচাই সম্পন্ন করা হয়েছে। ৫ হাজার হেক্টর জমিতে প্রদর্শণী প্লট স্থাপনের জন্য ৮ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়। এরমধ্যে ৩ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে প্রদর্শণী প্লট করা হয়েছে। বাকী ১ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে প্রদর্শণী প্লট করার জন্য ২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা অবশিষ্ট রয়েছে।

বিনামূল্যে ২ হাজার ৫০০ কৃষককে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকার বীজ বিতরণ করা হয়েছে। ১ কোটি ২০ লাখ টাকা মূল্যের ১ লাখ ২০ হাজার টি বিভিন্ন ফলের চারা কৃষকের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। বীজ সংরক্ষণে ১ হাজার ৫০০টি ড্রাম বিতরণের জন্য ১২ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়। এরমধ্যে ১ হাজার ২০০টি ড্রাম বিনামূল্যে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। অবশিষ্ট ৩০০টি ড্রাম এই বছর বিতরণ করা হবে। এ খাতে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা অবশিষ্ট রয়েছে। ২৫০টি ত্রিপল বিতরণের জন্য ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা পাওয়া যায়। এরমধ্যে ২০০টি ত্রিপল ফ্রি বিতরণ করা হয়েছে। বাকী ৫০টি ত্রিপল প্রকল্প শেষের আগেই বিতরণ করা হবে। এখানে মজুদ রয়েছে ৬৫ হাজার টাকা।

এগ্রিকেয়ার২৪.কমের আরোও নিউজ পড়তে পারেন:

টবে ড্রাগন ফল চাষ করবেন যেভাবে

সারাবছর ফলন দিবে শাওনের বারমাসি টমেটো

নতুন ফসল মুসলি চাষে হতে পারেন লাখপতি, কেজি ১২’শত টাকা

২ হাজার ৫০০টি বস্তার মধ্যে ২ হাজার বস্তা কৃষকের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। অবশিষ্ট ৫০০ বস্তা বিতরণের জন্য ৪২ হাজার টাকা মজুদ রয়েছে। দা,কাঁচি, খুন্তা, নিরানী বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। এরমধ্যে ২ লাখ টাকার দা,কাঁচি, খুন্তা, নিরানী বিতরণ করা হয়েছে। এই খাতে ৫০ হাজার টাকা অবশিষ্ট রয়েছে। এই বছর এইগুলো বিতরণ করা হবে। ৫ জেলায় ১৯০ টি মাল্টা, পেয়ারা, আম, লেবু ও মিশ্র ফলবাগান স্থাপনের জন্য ১ কোটি টাকা এই প্রকল্পে দেওয়া হয়। এরমধ্যে আমরা ১৭৫টি বাগান স্থাপন করে দিয়েছি। ১৫টি বাগান স্থাপন অবশিষ্ট রয়েছে। আমরা এ বছর এ বাগানগুলো করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।

ওই কৃষি বিজ্ঞানী আরো বলেন, গবেষণা কার্যক্রমের মাধ্যমে এলাকার উপযোগী ফসলের উপযোগিতা ও সম্ভাব্যতা চাই এবং কৃষক প্রশিক্ষণ, মাঠ দিবস, সেমিনার,কর্মশালার মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত উন্নত জাত ও প্রযুক্তির বিস্তার ঘটিয়ে কৃষকের আয় বৃদ্ধি করাই এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। কৃষকের আঙ্গিনায় আমরা ফলের চারা দিয়েছি। এখান থেকে ফল খেয়ে তারা পারিবারিক পুষ্টি পাচ্ছেন। এছাড়া ২০ একর জমির ওপর গোপালগঞ্জে আধুনিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আমরা ৫ জেলায় ১৭৫ টি মাল্টা, আম, লেবু, কুল, পেয়ারাসহ মিশ্র ফলের বাগান স্থাপন করে ১৭৫ জন কৃষককে স্বাবলম্বী করে দিয়েছি।

বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার দৈবজ্ঞহাটি গ্রামের কৃষক বাছেদ আলী (৫০) বলেন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বিভিন্ন জাতের ফসল প্রদর্শনী প্লটে আবাদ করে অধিক ফসল ঘরে তুলছি। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করে আয় বাড়ছে। আমদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটছে। আমাদের প্রদর্শনী প্লটে ফসলের বাম্পার ফলন দেখে এ অঞ্চলের কৃষক কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত জাতের ফসল আবাদে উৎসাহিত হচ্ছেন। কৃষি গবেষণা উদ্ভাবিত জাত উচ্চ ফলনশীল । এ জাতে ইাইব্রিড জাতের সমান ফলনপওয়া যায়।

গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলার কদমপুর গ্রামের কৃষক মোঃ ছামাউল ইসলাম (৫৫) বলেন, এ প্রকল্পের সহযোগিতায় আমি পেয়ারা, লেবু, মাল্টা ও বরই বাগান করে সফল হয়েছি। এখান থেকে আমি অনেক টাকা আয় করতে পারছি। আমার বাগানে অন্তত ২০ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। আমি ৪টি বাগান করে স্বাবলম্বী হয়েছি। এসব বাগানের আয় দিয়ে ভালভাবে সংসার চালাচ্ছি। প্রতিবছর লাখ লাখ টাকা সঞ্চয় করতে পারছি। এসব বাগান স্থাপনে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই প্রকল্প সব ধরণের সহযোগিতা করেছে। এইজন্য তাদের জন্যবাদ জানাই।

হাই ব্রিড জাত চাষ করে আমরা পরবর্তী বছরের জন্য বীজ রাখতে পারি না। কিন্তু কৃষি গবেষণা উদ্ভাবিত জাত চাষ করে আমরা পরবর্তী বছরের জন্য বীজ সংরক্ষণ করতে পারি। এ বীজ দিয়েই আমরা এলাকায় প্রতিবছর কৃষি গবেষণা উদ্ভাবিত ফসলের আবাদ সম্প্রসারণ করতে পারছি। এছাড়া আমাদের এলাকায় লবনের আগ্রাসন রয়েছে। কৃষি উৎপাদনের অনুক’ল পরিবেশ নেই। তারপরও কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের গবেষণা ও নীবিড় সহযোহিতায় আমরা উপযোগী ফসল চাষাবাদ করে টিকে থাকতে পারছি।

বাগেরহাট জেলার মোল্লাহাট উপজেলার গাংনী গ্রামের কৃষক রমজান মোল্লা বলেন, বিনামূল্যে বীজ, প্রশিক্ষণ, ছাত্রাক নাশক, পরামশসহ সব ধরণের সহযোগিতা নিয়ে আমি কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত জাতের বিভিন্ন ফসলের আবাদ করে বাম্পার ফলন পেয়েছি। এতে আমাদর আয় বাড়ছে। এছাড়া বিনামূল্যে মাল্টা, পেয়ারা, লেবু ও আমের চারা পেয়েছি। এগুলো বাড়ির আঙ্গিনায় রোপন করেছি। এখানে উৎপাদিত ফলে পরিবারের পুষ্টির চাহিদা পূরণ হচ্ছে। বিএআরআই প্রকল্পে বদলে গেছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সংবাদের তথ্য বাসস থেকে নেওয়া হয়েছে।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ