পার্থ বিশ্বাস, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: তিল বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম ভোজ্যতেল ফসল। সরিষা তালিকায় সর্বপ্রথমে থাকলেও অনেকে তিল চাষ করেন। তবে, চাষিরা কিছু চাষ ব্যবস্থাপনা ভুল করার কারণে ফলন অত্যন্ত কম ফলন পান। এছাড়া খরিপ-২ মৌসুমে অর্থ্যাৎ আগামী ভাদ্র মাসে চাষ করতে পারেন কিছু জাতের তিল। তাতে ফলনও মিলতে পারে ৩৬ থেকে ৩৭ মণ।

কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ (২০০১-২০১৭) অনুসারে বাংলাদেশে গড়ে প্রায় ৩৬০৮৭ হেক্টর জমিতে তিল চাষ হয় এবং মোট উৎপাদন প্রায় ৩০৩২৪ মেট্রিক টন। বাংলাদেশে খরিফ এবং রবি উভয় মৌসুমেই তিলের চাষ করা হয়।

পড়তে পারেন: পাঙ্গাস চাষে কোটিপতি সিঙ্গাপুর ফেরত বেলায়েত

তবে বর্তমানে দুই-তৃতীয়াংশ তিলের আবাদ খরিফ মৌসুমে হয়। বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে তিলের চাষ হলেও খরিফ মৌসুমের জন্য পাবনা, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, রাজশাহী, খুলনা, ফরিদপুর, বরিশাল, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, রাাঙ্গামাটি এবং এই জেলাগুলোর নিকটবর্তী অঞ্চল তিল চাষের জন্য অধিক উপযোগী। আমাদের দেশে সাধারণত কালো ও খয়েরি রঙের বীজের তিলের চাষ বেশি হয়। তিলের বীজে ৪২-৪৫% তেল এবং ২০% আমিষ থাকে। তিলের তেলে মানব শরীরের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ৮০% এর বেশি অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড আছে।

কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ ২০০১-২০১৭ অনুযায়ী তিলের জাতীয় গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ৮৪০ কেজি যা ২০০৫ সালের পূর্বে ছিল ৫০০-৬২০ কেজি। স¦াভাবিক ফলনের তুলনায় তিলের জাতীয় গড় ফলন এত কম হওয়ার মূলকারণ : অনাকাক্সিক্ষত ঝড় এরং ফুল আসা পর্যায়ের শুরুতে/শেষে অথবা ফলধারণ পর্যায়ে অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি এবং ছত্রাকনাশক দ্বারা বীজ শোধন, উপযুক্ত পরিচর্যা, এবং আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের অভাব। আবহাওয়ার গতিবিধি বিবেচনায় সঠিক সময়ে সেচ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা, উন্নত জাতের ব্যবহার, উপযুক্ত পরিচর্যা এবং আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে তিলের ফলন প্রতি হেক্টরে ১২০০ – ১৫০০ কেজি পাওয়া সম্ভব।

পড়তে পারেন: ‘হাঁড়িভাঙ্গা’ আমে ২০০ কোটি টাকার বাণিজ্য সম্ভাবনা

আবহাওয়ার গতিবিধি বিবেচনা : বর্তমানে আবহাওয়ার কিছুটা বৈরী আচরণের কারণে তিল চাষে অধিক ফলনের জন্য আবহাওয়ার গতিবিধি বিবেচনায় রেখে তিল বপনের তারিখ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিল রবি (১৬ অক্টোবর-১৫ মার্চ বা কার্তিক-ফাল্গুন) ও খরিফ উভয় মৌসুমে চাষ করা যায়। খরিফ-১ মৌসুমে অর্থাৎ ফাল্গুন-চৈত্র মাসে (মধ্য-ফেব্রুয়ারি হতে মধ্য-এপ্রিল), খরিফ-২ মৌসুমে অর্থাৎ ভাদ্র মাসে (মধ্য-আগস্ট হতে মধ্য-সেপ্টে¤¦র) তিলের বীজ বপনের উত্তম সময়।

যদি মধ্য ফেব্রুয়ারির মধ্যে তিল বপন করা যায় তবে অনাকাক্সিক্ষত ঝড় এরং ফুল আসা পর্যায়ের শুরুতে কিংবা শেষে অথবা ফলধারণ পর্যায় অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা এড়িয়ে মধ্য এপ্রিলের মধ্যে ফসল সংগ্রহ সম্ভব হয়। অবহেলা এবং জানার আগ্রহের অভাবে আমাদের অধিকাংশ কৃষকরা তিল বপনে দেরি করেন অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে তিল বপনে ব্যর্থ হন। ফলে তিল ফসল সংগ্রহের সময় মধ্য এপ্রিল পার হয়ে যায় এবং ফলধারণ পর্যায় অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা ও অনাকাক্সিক্ষত ঝড়ের কবলে পড়ে তিলের ফলন কমে যায় এবং কখনো কখনো গাছ মারাও যায়।

প্রধান প্রধান তিল উৎপাদন অঞ্চলের নিকটবর্তী আবহাওয়া স্টেশন এর বিগত পাঁচ বছরের মাসিক বৃষ্টিপাতের গড় এবং সেই অনুসারে অঞ্চল ভেদে তিল বপনের উপযোগী সময় টেবিল-১-এ উল্লেখ করা হলো।

এ ছাড়া বৈরী আবহাওয়ার কারণে বিগত কয়েক বছরের তথ্য অনুসারে মধ্য মে থেকে জুন মাসের মধ্যে অনাকাক্সিক্ষত ঝড় যেমন, আম্ফান (২০ মে ২০২০), ফণী (৪ মে ২০১৯), মোরা (২৯-৩১ মে ২০১৭), রোয়ানু (২১ মে ২০১৬), ভিয়ারু (১৬-১৭ মে ২০১৩) এবং আইলা (২৭-২৯ মে ২০০৯) বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে।

পড়তে পারেন: মাছ চাষে কোটিপতি ফরহাদ, চলতি বছরে ৭০ লাখ!

সেই বিবেচনায় তিল চাষে অধিক ফলন পেতে সব এলাকার জন্য তিল বপনের উপযোগী সময় ১৫-২০ ফেব্রুয়ারি। এই সময়ে বপন করলে অনাকাক্সিক্ষত ঝড় এবং অতিবৃষ্টি এড়ানো সম্ভব। এই সময়ে বীজ অঙ্কুরোদগমের উপযুক্ত তাপমাত্রা ২৫০ সেলসিয়াস বা এর বেশি বিরাজ করে তাই বীজ অঙ্কুরোদগম এবং চারা ঠিকমতো বাড়তে কোন সমস্যা হয় না।

মাটির ধরন : পানি জমে থাকে না এমন প্রায় সব ধরনের মাটিতে তিলের চাষ করা যায়। উঁচু বেলে দো-আঁশ বা দো-আঁশ মাটি তিল চাষের জন্য বেশি উপযোগী।

জাত নির্বাচন : অধিক ফলন পেতে উন্নত জাত যেমন- বিনা তিল-২, বিনা তিল-৩, বিনা তিল-৪, বারি তিল-৩ এবং বারি তিল-৪ খুবই উপযোগী। তবে জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু বিবেচনায় বিনা তিল-৪, বিনা তিল-৩ এবং বারি তিল-৪ তুলনামূলক অধিক উপযোগী।

পড়তে পারেন: ১২১টি তেলিয়া মাছে রাতারাতি কোটিপতি জেলে

বীজ শোধন : কা-পচা তিলের প্রধান রোগ যা বীজবাহিত। তাই বপনের পূর্বে প্রতি কেজি বীজের সাথে ২-৩ গ্রাম ভিটাভেক্স-২০০ ছত্রাক নাশক দ্বারা বীজ শোধন করে লাগালে এ রোগের আক্রমণ কমানো যায়।

বপন পদ্ধতি অনুসারে বীজের হার : ছিটিয়ে বপনের ক্ষেত্রে হেক্টর প্রতি ৮-৯ কেজি (বিঘা প্রতি ১-১.১৫ কেজি) এবং সারিতে বপনের ক্ষেত্রে হেক্টরপ্রতি ৭.০-৭.৫ কেজি (বিঘা প্রতি ১ কেজি)। সারিতে বপন করলে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫-৩০ সেমি. ও গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৫ সেমি. রাখতে হবে।

সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি : মাটির উর্বরতা ভেদে সারের চাহিদার কিছুটা তারতম্য হতে পারে। মধ্যম শ্রেণীর উর্বর মাটির জন্য টেবিল-২ অনুসারে সার প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সারের অর্ধেক ও বাকি সব সার জমি শেষ চাষের সময় ছিটিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি ইউরিয়া বীজ বপনের ২৫-৩০ দিন পর ফুল আসার সময় উপরি প্রয়োগ করতে হবে।

সেচ প্রয়োগ ও পানি নিষ্কাশন : ফসলের ক্ষেত্রে পানি ব্যবস্থাপনা বলতে কাক্সিক্ষত ফলনের জন্য জমিতে প্রয়োজনীয় সেচ বা অতিরিক্ত পানি অপসারণকে বোঝায়। সাধারণত খরিফ-১ মৌসুমে তিল বোনার সময় মাটিতে প্রায়ই রসের অভাব পরিলক্ষিত হয়। মাটিতে পর্যাপ্ত রস বা আর্দ্রতা না থাকলে বীজ গজানোর বিষয়টি নিশ্চত করতে বপনের পূর্বে জমিতে অবশ্যই একটি সেচ দিতে হবে এবং মাটিতে জো আসার পর চাষ দিয়ে বীজ বপন করতে হবে। তিল ফসল খরা সহনশীল হলেও ফুল আসার সময় জমিতে রসের অভাব হলে (সাধারণত বীজ বোনার ২৫-৩০ দিন পর) ফুল আসার পূর্বে এক বার সেচের প্রয়োজন হয়।

পড়তে পারেন: কোন তেল ব্যবহার করবেন-সয়াবিন নাকি সরিষা?

জমিতে রস না থাকলে ৫৫-৬০ দিন পর ফল ধরার সময় আর একবার সেচ দিতে হবে। উল্লেখ্য যে, তিল ফসল দীর্ঘ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। সাধারণত ৪৮-৫২ ঘণ্টার বেশি একটানা জলাবদ্ধতা থাকার পর তিল গাছ পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতে পারে না। আর এ অবস্থার পর যদি ৩-৫ দিন রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া বিরাজ করে তবে তিল গাছ মারা যায়।

জলাবদ্ধতা বা অতিরিক্ত আর্দ্রতা তিল চাষের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এক্ষেত্রে দ্রুত গোড়াপচা রোগ হয়ে তিলগাছ মারা যায়। এজন্য জমি প্রস্তুতের সময় পানি নিষ্কাশনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তাই জমির মধ্যে মাঝে মাঝে নালা কেটে বৃষ্টি বা সেচের অতিরিক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে ফসলকে রক্ষা করতে হবে।
রোগবালাই দমন

কান্ড পচা রোগ : কলেটোট্রিকাম ডেমাশিয়াম নামক ছত্রাক থেকে এ রোগ সৃষ্টি হয়। জমিতে কা-পচা রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে বাজারে যে সকল ছত্রাকনাশক পাওয়া যায়, যেমন ব্যাভিস্টিন বা ডাইথেন এম-৪৫ দুই গ্রাম হারে বা রোভরাল এক গ্রাম হারে প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ৮-১০ দিন পর পর তিনবার দুপুর ২-৩ ঘটিকার সময় ফসলে ¯েপ্র করে রোগটি দমন করা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে উত্তম হবে, জমিতে জলাবদ্ধতা বা অতিরিক্ত আর্দ্রতা লক্ষ্য করা মাত্র ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করা।

পড়তে পারেন: চাষ ছাড়াই “বিনা সরিষা-৯” আবাদ

বিছাপোকা ও হক মথ : এ পোকা তিল গাছে আক্রমণ করে ক্ষতি করে থাকে। এ পোকা ডিম পাড়ার পর অথবা ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার সাথে সাথে ডিমসহ পাতা ছিঁড়ে পানি মিশ্রিত কেরোসিন বা ডিজেলে ডুবিয়ে মেরে ফেলা যেতে পারে। পোকার আক্রমণ বেশি হলে সেভিন ৮৫ এসপি কীটনাশকের ৩৪ গ্রাম পাউডার প্রতি ১০ লিটার পানিতে অথবা অ্যাডভান্টেজ ২০ এসসি এর ৩০ মিলিলিটার প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত জমিতে ¯েপ্র করতে হবে। তিলের হক মথ দমনের ক্ষেত্রেও বিছাপোকা দমনের ন্যায় একই পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে।

শেষকথা হলো, বৈরী আবহাওয়ায় সঠিক সময়ে বপন, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা এবং আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে তিলের ফলন বাড়ানোর মাধ্যমে ভোজ্যতেলের চাহিদা অনেকাংশে মেটানো সম্ভব।

ভাদ্র মাসেই চাষ করুন তিল, হেক্টরে ফলন ৩৭ মণ লেখাটির লেখক পার্থ বিশ্বাস বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কৃষি প্রকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), ময়মনসিংহ-২২০২; মোবাইল : ০১৭২৭৬৫৬২১৬।

 

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ