ডেস্ক প্রতিবেদন, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: বাংলাদেশ, শ্রীলংকা-সহ উপসাগরীয় কিছু দেশে ভারতের উৎপাদিত পেঁয়াজ রপ্তানি হয়ে থাকে। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে ভারতীয় ‘পেঁয়াজ’ রপ্তানি বন্ধে কার ক্ষতি, কার লাভ? এমন প্রশ্ন প্রায়ই আলোচিত হয়।

ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য প্রিন্ট দেশটির পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করা নিয়ে এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে এ পদক্ষেপের প্রভাব এবং প্রকৃত সমাধান সম্পর্কে আলোচনা প্রাধান্য পায়। সাংবাদিক ইলা পাটনায়েক ও রাধিকা পান্ডের লেখা ওই নিবন্ধটি এখানে তুলে ধরা হলো;

সাম্প্রতিক সময়ে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধে এক নিষেধাজ্ঞা দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। গত দুই মাস ধরে পাইকারি বাজারে পণ্যটির ক্রমশ দরবৃদ্ধির প্রেক্ষিতেই এ সিদ্ধান্ত। ওই সময়ে খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দর কেজিপ্রতি ৩৫-৪০ রুপিতে উন্নীত হয়। সে তুলনায় গত জুনে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২৫-৩০ রুপি দরে। অর্থাৎ, মূল্য ব্যবধান খুব বেশি গুরুতর ছিল না।

দাম বাড়ার পেছনে মূল ভূমিকা রাখে গত আগস্টের ভারি বর্ষণ। যেকারণে সবজি জাতীয় ফসলটির অন্যতম উৎপাদন কেন্দ্র কর্ণাটক রাজ্যে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এতে সেখানকার প্রায় সব পেঁয়াজ চাষের জমিই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কর্ণাটকে চাষ করা পেঁয়াজের চালান চলতি সেপ্টেম্বরে বাজারে আসার কথা ছিল। সেই সরবরাহ না থাকাতেই কেজিপ্রতি আংশিক দরবৃদ্ধি।

আরোও পড়ুন: পেঁয়াজ সংকট নিরসনে চার অঞ্চলে ক্রপিং জোন স্থাপনের পরামর্শ

এবার মিয়ানমার ও পাকিস্তান থেকে এলো পেঁয়াজের চালান

ভারতে উৎপাদিত পেঁয়াজ বাংলাদেশ, শ্রীলংকা-সহ উপসাগরীয় কিছু দেশে রপ্তানি করা হয়। চলতি বছরের বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত বর্ষণের কারণে শ্রীলঙ্কার নিজস্ব পেঁয়াজ উৎপাদন সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। যেকারণে, দেশটিতে এবার ভারতীয় পেঁয়াজের আমদানি চাহিদা অনেকগুণ বেড়েছে।

একথা ঠিক, ভারতের স্থানীয় বাজারে সরবরাহ সঙ্কট ভোক্তাপর্যায়ে মূল্যস্ফীতি তৈরি করবে এবং ইতোমধ্যেই মহামারির কারণে অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়া ভোক্তাদের প্রভাবিত করবে। একারণেই, রপ্তানি উৎস বন্ধের মাধ্যমে- আয় সীমিত হয়ে পড়া পরিবারগুলোকে সাময়িক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দেওয়া হয়। তবে এ পদক্ষেপ ভোক্তাদের জন্য স্বস্তির হলেও, তাতে ক্ষতি হয় কৃষকের।

বাঁধাগ্রস্ত হয়েছে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার সরকারি লক্ষ্যমাত্রা:

বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার, ২০২৪ সাল নাগাদ ভারতীয় কৃষকের গড় আয় বর্তমানের চাইতে দ্বিগুণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু, রপ্তানি বন্ধ থাকলে তা কী আদৌ অর্জন করা সম্ভব? –এমন প্রশ্ন উঠছে।

অধিক ফলন থেকে যেমন বেশি আয় করতে পারেন চাষিরা, ঠিক তেমনি বাজারে উচ্চদর থাকলেও তারা লাভবান হন। বাস্তবতা হচ্ছে, খুব বেশি সরবরাহতে বরং বাজারে হঠাৎ করে দরপতন দেখা দিতে পারে। তখন বাধ্য হয়েই নিজেদের কষ্টের ফলন নষ্ট হয় কৃষকের। একারণেই সাম্প্রতিক বছরে রাস্তায় টমেটো এবং পেঁয়াজের মতো পণ্য ফেলে তাদের প্রতিবাদ জানাতে দেখা গেছে।

কৃষকের জন্য ন্যায্যদর নিশ্চিতে সম্প্রতি তিনটি উল্লেখযোগ্য সংস্কার করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এ লক্ষ্যে পার্লামেন্টে পাস করা হয়েছে; কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণ, চুক্তিভিত্তিক চাষ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য অধ্যাদেশ- নামক তিনটি বিল। কৃষকের জন্য মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্মমুক্ত বাজারজাতকরণ সুবিধা দিয়ে তাদের আয় বৃদ্ধির প্রচেষ্টা এসব আইন।

আরোও পড়ুন: ‘দেশি পেঁয়াজের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াতে হবে’

তাছাড়া, সাম্প্রতিক সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার এক লাখ কোটি রুপির কৃষি-অবকাঠামো তহবিল গঠন করেছে। এর আওতায়, নতুন কৃষি উদ্যোগ, কৃষি সমবায় এবং কৃষিখাতের উদ্যোগগুলোকে; হিমাগার, গুদামঘর এবং অন্যান্য সহকারী অবকাঠামো নির্মাণে ভর্তুকি-সহ ঋণ দেওয়া হবে। ফসল বেশি উৎপাদিত হলে, তা যেন সংরক্ষণ করে কৃষককে লোকসানের হাত থেকে রক্ষা করা যায়, সেজন্যই এ উদ্যোগ। এবং বাস্তবতা হচ্ছে, এটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার।

সন্দেহ নেই, এসব যথাযথ এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ। কিন্তু, তারপরও বর্তমানে প্রাসঙ্গিক বাজার পরিস্থিতিতে পেঁয়াজের রপ্তানি বন্ধ কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।

ক্ষোভের কারণ নেহাত স্বার্থহানি নয়, কোভিডের কারণে পর্যদুস্ত হয়েছে ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতিও। সেখানে বাড়তি দরের সুবাদে এ মৌসুমে কিছুটা বেশি আয়ের আশা করেছিলেন চাষিরা।

পেঁয়াজের দর সবসময় অস্থিতিশীল। উৎপাদন বেশি হলে এবং ন্যায্যমূল্য না পেলে চাষিরাই তখন ক্ষতির ভার-বহন করেন। স্থানীয় বাজারেও সরকার নির্ধারিত মূল্যে ফসল সংগ্রহের কারণে বেশি দামের সুবিধাটা চাষিদের ঘরে পৌঁছায় না। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চদর থাকলে সেক্ষেত্রে বাড়তি আয়ের সুযোগ থাকে তাদের। এখন রপ্তানি বন্ধের কারণে স্থানীয় বাজারে যথেষ্ট সরবরাহ তাদের কাঙ্খিত লাভ থেকে দূরে রাখছে। অতীতে দরপতনের কারণে হওয়া ক্ষতিটাও তারা পুষিয়ে উঠতে পারছেন না।

সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রভাব:

কৃষিখাতের এ আয় কমা সামগ্রিক গ্রামীণ অর্থনীতিকে মহামারির মধ্যে আরও বড় আঘাত করবে।

নজর দেওয়া দরকার সামগ্রিক অর্থনীতির দিকেও। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ভারতের গড় দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) ২৩.৯ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। কিন্তু, শিল্পখাতে অচলাবস্থার ঘোর অন্ধকারে আশা জাগিয়েছিল কৃষি এবং এর সহযোগী কার্যক্রমগুলি। সদ্য সমাপ্ত প্রান্তিকে যা ৩.৪ শতাংশ বাড়ে। সেই তুলনায়, গত অর্থবছরের একই প্রান্তিকে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ৩ শতাংশ।

সাধারণত শিল্পোৎপাদন এবং সেবাখাতই ভারতের জিডিপি বিকাশে নেতৃত্ব দেয়। তবে, মহামারির চলমান নজিরবিহীন সঙ্কটের মধ্যে সবচেয়ে ভালো করেছে কৃষিখাত।

এবছর বীজ বপণের জন্য অনুকূল আবহাওয়া এবং মৌসুমি বৃষ্টির আশীর্বাদে; কৃষির ফলন বেশ ভালোই হয়েছে। বন্যার কারণে বাজার সরবরাহ পেঁয়াজের মতো কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে কম হওয়ায়, ভালো দামও পাচ্ছিলেন চাষিরা। কিন্তু, সেই আকর্ষণীয় দর সরকারের রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তে হারিয়ে গেছে। আর দর ধরে রাখা না গেলে জিডিপিতে কৃষিখাতের গড় মূল্য সংযোজনটাও (জিভিএ) কম হবে।

সম্প্রতি এমন উদ্বেগ ব্যক্ত করেছেন ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক- রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) গভর্নর শক্তিকান্ত দাস। কৃষি সহযোগী বানিজ্যিক ব্যবস্থা বিকাশের দিকে গুরুত্ব আরোপ করে তিনি জানান, কৃষিবান্ধব বাজার তৈরি করা না গেলে কৃষিখাত থেকে শক্তিশালী জিভিএ অর্জন করা সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে, বিদেশী বাজারে রপ্তানির বাণিজ্যের সুযোগ এবং নতুন প্রযুক্তির সুবিধা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি যোগ করবে, বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

তবে কেন্দ্রীয় সরকার যে তার সে উপদেশে কান দেয়নি, তা স্পষ্ট প্রতিফলিত হচ্ছে।

পেঁয়াজ রপ্তানি রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল:

পেঁয়াজ প্রসঙ্গ ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং বৈদেশিক সম্পর্ক- উভয়ক্ষেত্রেই সংবেদনশীল। ভারত-সহ প্রতিবেশী বাংলাদেশ, শ্রীলংকা এবং নেপালে শহুরে ক্রেতা শ্রেণির জন্য দরকার, সবজিটির ধারাবাহিক যোগান।
দক্ষিণ এশিয় রন্ধনশৈলীর প্রধানতম অঙ্গ হওয়ায়, এটি ভারতের মিত্র দেশগুলোর জন্য রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর বিষয়।

ভারত থেকে আমদানি করা হয়, স্থানীয় বাজারে মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে। সেখানে হঠাৎ করে রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত, সরকারগুলোর জন্য অস্বস্তির কারণ হয়। আমদানিকারকেরা রপ্তানি উৎস হিসেবে ভারতের নির্ভরযোগ্যতার বিষয়েও সন্দিহান হয়ে পড়েন।

২০০৪-০৫ থেকে ২০১১-১২ অর্থবছরে ভারতের ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অর্গানাইজেশন- ভোক্তাব্যয় নিয়ে এক সমীক্ষা পরিচালনা করে। সেখানে দেখা যায়, ওই সময়ে শস্যজাত খাদ্যপণ্যের পেছনে ভোক্তাব্যয় অনেকাংশে হ্রাস পায়। তারপরেই ব্যয় কমে সবজি এবং নানা প্রকার ডাল ক্রয়ে। সেই তুলনায় তাদের ব্যয় বেড়েছে; দুধ, মাংস, ডিম এবং ফলমূলের পেছনে।

এরপরও সরকার রপ্তানি বন্ধের আকস্মিক সিদ্ধান্ত নিল, যা ১৯৯২ সালের বৈদেশিক বাণিজ্য (উন্নয়ন এবং নিয়ন্ত্রণ) আইনের পরিপন্থী। ওই আইনের আওতায় স্থানীয় বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় সরকারকে রপ্তানি বন্ধ, নিয়ন্ত্রণ এবং তাতে কড়াকড়ি আরোপের ক্ষমতা দেওয়া হয়।

২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের মেয়াদে কেন্দ্রীয় সরকার এ আইনটির আওতায় পেঁয়াজ রপ্তানির নীতি ১৭ বার পরিবর্তন করেছে। অর্থাৎ, প্রতিবছর গড়ে তিনবার তা পরিবর্তন হয়। ফলে রপ্তানি বাজার লক্ষ্য করে উৎপাদন করা কৃষকেরা আইনী অবস্থা সম্পর্কে স্থায়ী ধারণা পান না। একইসঙ্গে, প্রতিবেশীদের কাছেও এর মাধ্যমে ভারতের শত্রুতাভাবাপন্ন ভাবমূর্তি প্রতিভাত হয়।

ভারতীয় ‘পেঁয়াজ’ রপ্তানি বন্ধে কার ক্ষতি, কার লাভ? শিরোনামে সংবাদের তথ্য দ্য প্রিন্ট থেকে অনুবাদ করেছেন নূর মাজিদ।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ