নিজস্ব প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: কোভিড-১৯ প্রভাব মোকাবেলায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ৫ হাজার কোটি টাকা করার প্রস্তাবনা দিয়েছে বাংলাদেশ ডেইরী ডেভেলপমেন্ট ফোরাম (বিডিডিএফ)। প্রস্তাবিত চলতি ২০২০-২০২১ বাজেটে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করে সংগঠনটি।

আজ বৃহস্পতিবার ২৫ জুন ২০২ এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ফোরামের সভাপতি এডভোকেট উম্মে কুলসুম স্মৃাতি এমপি ১২ দফা দাবিসহ এ সুপারিশ করেন। সংবাদসম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, ফোরামের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক প্রফেসর ড. কেবিএম সাইফুল ইসলাম।

সম্মেলনে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২.০-২.৫ কোটি লিটার তরল দুধ উৎপাদন হয় যার বাজার মূল্য প্রায় ১০০-১২০ কোটি টাকা। কোভিড-১৯ এর ফলে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি খাতই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত হচ্ছে কৃষি ও প্রাণিসম্পদ খাত। ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা গেছে মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে মে’র প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত মাত্র দেড় মাসে কৃষকের লোকসান হয়েছে ৫৬৫৩৬ কোটি টাকারও বেশী। কারণ, কৃষি ও প্রাণিসম্পদ খাতের উৎপাদিত পণ্যসমূহ উচ্চপচনশীল এবং তা স্বল্প সময়ের মধ্যে বাজারজাত করতে হয়। কোভিড-১৯ এর ফলে খামারীরা তাদের উৎপাদিত দুধ বিক্রি করতে না পারায় খামারীরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

তাছাড়া খামারীরা গাভীগুলোকেও পর্যাপ্ত গো-খাদ্য সরবরাহ করতে পারছে না, ফলে দেখা দিচ্ছে গবাদিপ্রাণির নানাবিধ অসুখ ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা। তাছাড়া বিপনন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কোম্পানিগুলোও সক্ষমতা অনুযায়ী দুধ সংগ্রহ, প্রক্রিয়া ও বিক্রয় করতে পারছে না। দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কোম্পানিগুলোর ভাষ্যমতে, তাদের বিক্রয় প্রায় ৪০-৫০ শতাংশে নেমে এসেছে। এমতাবস্থায় খামারীসহ সেক্টর সংশ্লিষ্ট সকলের ক্ষতি বিবেচনা বিগত তিন মাসে (মার্চ থেকে মে) এ খাতে লোকসান হয়েছে প্রায় ৪০০০ কোটি টাকা।

কোন খামারের গো-খাদ্য বাবদ ৫০ শতাংশের বেশী খরচ হলে ঐ খামার বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু বাংলাদেশে ডেইরী খামারের উৎপাদন খরচের শতকরা ৭০-৭৫ শতাংশ ব্যয় হয় গো-খাদ্য ক্রয়ে। এর জন্য খামারের অব্যবস্থাপনা, উন্নত জাতের গাভীর অভাব দায়ী থাকলেও মূল সমস্যা হলো গো-খাদ্যের উচ্চ মূল্য। বাংলাদেশে গো-খাদ্য মূলত আমদানি নির্ভর। গো-খাদ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বর্তমান প্রস্তাবিত বাজেটে কতিপয় খাদ্য উপাদান যেমন-সয়াবিন অয়েল কেক (আরডি ৫%) এবং সয়াবিন প্রোটিন কনসেনট্রেট (সিডি ১০%) এর আমদানিশুল্ক কমানোর হয়েছে যা সত্যিই প্রশংসনীয় । তবে খামারের উৎপাদন অব্যহত রাখার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গো-খাদ্যে ভর্তূকি দেয়ার প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশের কৃষিখাতেও বর্তমান বাজেটে ভর্তূকির পরিমান ৯৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু ডেইরী খাতে অদ্যাবধি এধরনের কোন ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়নি। এই কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র খামারীদের সুরক্ষায় গো-খাদ্যের উপর ভর্তূকি দেয়া আবশ্যক।

বাংলাদেশের ডেইরী শিল্পের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আমদানিকৃত গুঁড়া দুধের সাথে অসম প্রতিযোগিতা। এসব গুঁড়া দুধ ভর্তূকি প্রাপ্ত হওয়ায় এর দাম তুলনামূলকভাবে অনেক কম যার সাথে বাংলাদেশের স্থানীয় উৎপাদন প্রতিযোগীতা করতে পারে না। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ গুঁড়া দুধের আমদানি ব্যয় মেটাতে প্রায় ২৮৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে। বাংলাদেশে গুঁড়া দুধের আমদানিশুল্ক মাত্র ১০%। কিন্তু এশিয়ার অন্যান্য দেশে এর হার ৫০ শতাংশের উপরে। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার ২.৫ কেজি প্যাকেটজাত গুঁড়া দুধের আমদানিশুল্ক বাড়ানোর ঘোষনা দিয়েছে। কিন্ত এই আমদানিশুল্কবৃদ্ধি প্রকৃতপক্ষে দেশের ডেইরীর উন্নয়নে তেমন ভূমিকা রাখবে না। এক্ষেত্রে বাল্ক ফিল্ড মিল্কের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

দেশের ডেইরী সেক্টরের উন্নয়নের জন্য দেশীয় পণ্যকে আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে প্রতিযোগীতাপূর্ণ হতে হবে। এক্ষত্রে খামারের উৎপাদন খরচ বেশী হওয়ায় ডেইরী পণ্যের উৎপাদন খরচও বেশী হয়। ফলে জাতীয় বাজারে ডেইরী পণ্য ভোক্তাবান্ধব না হওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে তা প্রতিযোগিতা করে টিকতে পারে না। এক্ষেত্রে দেশে উৎপাদিত সকল ডেইরী পণ্যের উপর থেকে মূল্য সংয়োজন কর এবং শুল্ক প্রত্যাহার করা জরুরী। তাছাড়া করোনার আঘাত থেকে মুক্ত করে ডেইরী সেক্টরকে টেকসই ও মজবুত উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষে প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে ১০ বছরের জন্য ‘‘ট্যাক্স হলি ডে” ঘোষণা করা উচিত।

ডেইরী খাতে কোভিড-১৯ এর প্রভাব মোকাবেলায় জাতীয় বাজেট ২০২০-২১ এ বাংলাদেশ ডেইরী ডেভেলপমেন্ট ফোরামের সুপারিশসমূহঃ
১. ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে বরাদ্দ কমপক্ষে ৫০০০ কোটি টাকা করা।
২. কোভিড-১৯ এর ক্ষতি মোকাবেলায় খামারীদের গো-খাদ্য ও খামারের উপকরণ ক্রয়ের জন্য ভর্তূকি প্রদান করা।
৩. সকল প্রকার দুগ্ধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ আমাদানী শুল্ক (Customs Duty) আরোপ করা। বিশেষ করে এইচ এস কোড 0402.21.91 (Milk & cream in powd,gran or oth. solid form fat..exceed1.5% imp by VAT reg.Milk & pr) এবং এইচ এস কোড 0402.21.99 (MILK AND CREAM IN POWDER,…OF FAT >1.5% IMP.EXCL.VAT REG. MILK & MILK MFG.IND. এ যথাক্রমে ২৫% এবং ২০% CD ও SD আরোপ করা।
৪. দেশে উৎপাদিত সকল প্রকার ডেইরী পণ্যে শুল্ক ও কর শূন্য হারে (০%) নির্ধারণ করা।
৫. স্থানীয় অপ্রাতিষ্ঠানিক বাজারকে ডিজিটালাইজড ও প্রাতিষ্ঠানিক বাজারকে শক্তিশালীকরণের জন্য মধ্যম/দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় টাকার ‘‘গ্যারান্টি ফান্ড” গঠন করা।
৬. সম্প্রসারণ সেবাকে ডিজিটালাইজড ও খামারীবান্ধব করা।
৭. গো-খাদ্যসহ সকল প্রকার ডেইরী উপকরণের আমদানিশুল্ক প্রত্যাহার করা।
৮. ডেইরী খাতে আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির সন্নিবেশ ঘটানোর জন্য মধ্যম/দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় ‘‘গ্যারান্টি ফান্ড” গঠন করা।
৯. ডেইরীতে বিনিয়োগের ঝুঁকি কমাতে গাভী বীমা চালু করা।
১০. প্রান্তিক কৃষক যাতে সহজেই ৫০০০ কোটি টাকা প্রণোদনার অন্তর্ভূক্ত হয় সেজন্য লম্বা গ্রেস পেরিয়ডসহ জামানতবিহীন ঋণ সুবিধা