জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস, কৃষিবিজ্ঞানের ফেরিওয়ালা, গাজীপুর, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: ধানের ব্লাস্ট নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে চারদিকে। অনেকেই ভাবছেন বোরোর ফলনে এর কোনো প্রভাব পড়ে কিনা। আমিও প্রথমে বেশ দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। কারণ যেভাবে বিষয়টি মিডিয়াতে আলোচিত হচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে ব্রির সাথে কথা বলেছি। তারা ক্ষতির তীব্রতা যাচাই করার জন্য নয়টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের সাহায্যে সাতটি পর্যবেক্ষক দল গঠন করেছিল। দলটি সারা দেশের ১৪টি ব্লাস্ট আক্রান্ত অঞ্চল পরীক্ষা করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। তাদের ভাষায় এ বছর মোট বোরো আবাদ হয়েছে ৪৯, ৮৭৮১১ (৪.৯৮ মিলিয়ন) হেক্টর জমিতে।

এর মধ্যে আক্রান্ত জমির পরিমাণ মাত্র ২৭২০ হেক্টর। হিসেব মতে মোট উৎপাদন থেকে ধানের উৎপাদন কমে যাবে মাত্র ২৪৮০ মেট্রিক টন। কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকেও এমনি ধরনের একটি জরিপ চালানো হয়েছে। তাদের হিসেবও ব্রির হিসেবেরে কাছাকাছি। তারা বলছে আক্রান্ত জমির পরিমাণ ২৩১৫.৫০ হেক্টর।

মোট জমির মাত্র শতকরা ০.০৪৬ ভাগ। এ সমস্ত জমির ফসল সর্বোচ্চ ২০% ক্ষতি হতে পারে। সেই হিসেবে কৃষিসম্প্রসারণ বলছে যে ১৮৫৭ মেট্রিক টন ফলন কমতে পারে। যা মোট ফলনের শতকরা ০.০০৯৩ ভাগ মাত্র। উপাত্তদৃষ্টে দিব্যি বোঝা যায় যে ব্রি এবং কৃষিসম্প্রসারণ অধিপ্তরের হিসেবের মধ্যে তেমন কোনো ফারাক নেই। এ জরিপ থেকে আমরা স্পষ্ট করেই বলে দিতে পারি যে মিডিয়াতে যতই বলা হোক না কেন জাতীয় পর্যায়ে এই ক্ষতি ধর্তব্যের মধ্যে নয়। তবে যে কৃষক ব্যাক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তার জন্য এই ক্ষতি অপূরণীয়।

এখানে একটি বিষয় সবার জানার দরকার আছে। রোগটি কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে। ফলে মাঠে ব্রি এবং সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আগে থেকেই সতর্ক ছিল। ব্রি আবহাওয়ার পূর্বাভাষ বিশ্লেষণ করে আগে থেকেই বেশকিছু সতকতামূলর্ক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তারা কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং কৃষি গবেষণার সাহায্যে বোরো মওসুমের শুরুতে ৬০০, ০০০ কপি ফ্যাক্টশীট বিতরণ।

গত ১৭ এবং ২৫ মার্চ কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুম এবং সকল উপপরিচালকবৃন্দের কাছে ইমেইল মারফত বিশেষ আগামবার্তা প্রেরণ করে। এ ছাড়াও কৃষি কারিগরি কমিটি এবং জেলা কারিগরি কমিটিগুলোতে বিশেষ জোর দিয়ে ব্লাস্ট-ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আলোচনা করে। এবং সরেজমিনে উদ্ভূত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য সাতটি পর্যবেক্ষক দল গঠন করে। 

এ সমস্ত কারণেই ব্লাস্ট যে খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে বলে আমি মনে করি না। অনেক ক্ষেত্রেই কৃষকরা কৃষিবিভাগের পরামর্শমত প্রতিরোধী ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, ফরিদপুর অঞ্চলে এ রোগে আক্রান্ত জমি নেই বললেই চলে।

কারণ এসমস্ত জায়গার কৃষকেরা পরামর্শ মোতাবেক প্রতিরোধী ব্যবস্থা নিয়েছিল বলে জানা জায়। যেখানে কৃষকরা যথাসময়ে ব্যবস্থা নিতে পারেনি সেখানেই এরোগের আক্রমণ দেখা গেছে বলে ব্রি ও কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যাচ্ছে।

যাহোক এ বছর এ রোগের আক্রমণের ব্যপকতা তেমন না হলেও আগামী বছর যে বেশি হবে না তা বলা যায় না। কারণ ব্রির হাতে এখনও তেমন প্রতিরোধী জাত নেই। আর রোগের সংক্রমণ আবহাওয়া এবং ফসলের বৃদ্ধি-অবস্থার উপর বেশিরভাগ নির্ভর করে।

আরেকটা বিষয় হলো আমাদের দেশে এই রোগের কমপক্ষে ২৬৭ টি উপজাত আছে। এবং প্রতিনিয়ত তারা তাদের নতুন নতুন উপজাত তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছে। ফলে একটি জাত যদি কোনো বিশেষ উপজাতের বিরূদ্ধে সহণশীল হলেও আরেকটির বিরূদ্ধে নাও হতে পারে। সেটাই হলো এ ধরনের রোগের বিরূদ্ধে প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবনের প্রধান সমস্যা। তবুও বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করে যাচ্ছে।

তারা বাংলাদেশের জন্য (Pi9, Pish, Pb1, Pita2) নামের চারটি উপযোগী জিনের সন্ধান পেয়েছেন এবং এগুলো দেশে উদ্ভাবিত জাতে সংযোজন করে নতুন জাত উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়াও আমাদের বিজ্ঞানীরা বিদেশে কাজ করার সময়ও ইরি ও ব্রি উদ্ভাবিত কিছু জাতগুলোর মধ্যে এই জিনগুলো সংযোজন করে আরও উন্নয়নের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

এমনিভাবে উদ্ভাবিত একটি কৌলিক সারি হলো ওজ৬৪ চর৯। জাতটির ব্লাস্ট সহনশীলতা চমৎকার। ফলনও ভালো। জীবনকাল ব্রি ধান২৮ এর কাছাকাছি। কিন্তু সমস্যা  হলো ভাত নরম হয়ে যায়। যাহোক আরও গবেষণা চলছে। আমি অন্তত তাহমিদ আনছারী, আশিক ইকবাল এবং মোঃ আব্দুল লতিফ। ওদের কাজ সম্বন্ধে কিছু খবর রাখি। তারা ভালো কাজ করছে।

যাহোক এখনকার মত ব্লাস্ট দমনের জন্য বালাইনাশক স্প্রেসহ কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনাই উত্তম। তবে ভবিষ্যতে আমরা সহনশীল জাত পাবো। এ বিষয়ে একজাত চাষ না করে একই মাঠে এমনকি একই জমিতে নানা ধরনের জাত চাষ করা যেতে পারে। আর প্রয়োজনের বা দুঃসময়ে ডিলার বা বালাইনাশক কোম্পানির এজেন্টদের কাছে না গিয়ে মাঠ পর্যায়ের কৃষিকর্মকর্তাদের ্কাছে আগে গিয়ে তাদের থেকে পরামর্শ নিতে হবে। কারণ ডিলার বা কোম্পানি এজেন্ট সবসময় নিজের লাভটাই বড় করে দেখবে কিন্তু কৃষিকর্মকর্তারা কৃষকের কথাই আগে চিন্তা করবে। 

শেষ কথা হলো, মিডিয়া কৃষি সম্প্রসারণে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখছে। তারা অবশ্যই বিভিন্ন ধরনের মাঠের পরিস্থিতি দেশকে জানাবে। একই সাথে তাদের কাছে আবেদন তারা যেন মাঠের ভালোমন্দ পরিস্থিতিগুলো স্বাভাবিকভাবে তুলে ধরেন। নইলে সবার মধ্যে একটি আতঙ্ক তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

লেখক: জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস, কৃষিবিজ্ঞানের ফেরিওয়ালা, আন্তর্জাতিক ধান গবেষনা প্রতিষ্ঠানের জাতীয় পরামর্শক, সাবেক মহাপরিচালক বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর।