অর্থ-বাণিজ্য ডেস্ক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম ১৪ বছরের সর্বোচ্চে উঠেছে। ঊর্ধ্বমুখী অন্যান্য খাদ্যশস্যের দামও। এ অবস্থায় খাদ্যশস্য আমদানিতে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের দেশগুলোকে ৪০ শতাংশের বেশি বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হবে।

ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব এরই মধ্যে বিশ্ববাজারে তীব্রভাবে পড়তে শুরু করেছে। জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যসহ আন্তর্জাতিক বাজারে অস্তিরতা শুরু হয়েছে। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে মারাত্মক খাদ্য সংকটে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলোয়। সরবরাহ চেইন স্বাভাবিক রাখতে হিমশিম খাওয়া এসব দেশের সরকারের সামনে চলমান যুদ্ধ নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।

পড়তে পারেন: মহাদেবপুরে বারি গম চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, বিশ্ববাজারে কৃষ্ণ সাগরীয় দেশগুলোয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে খাদ্যশস্য সরবরাহ হয়। এর মধ্যে রাশিয়া ও ইউক্রেন বড় অংশ রফতানি করে। দেশ দুটি যৌথভাবে প্রায় ৩০ শতাংশ গম রফতানি করে। আর আন্তর্জাতিক বাজারের মোট ভুট্টার প্রায় ১৩ শতাংশ এককভাবে সরবরাহ করে ইউক্রেন।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, আলজেরিয়া ও লিবিয়াসহ জ্বালানি তেল উৎপাদক উপসাগরীয় অনেক দেশই বাড়তি মূল্যে খাদ্যশস্য আমদানি করতে পারবে। জ্বালানি পণ্য বিক্রি থেকে আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের জন্য চাপ কিছুটা কমবে। কিন্তু অন্যদের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

পড়তে পারেন: চাল-গম আমদানি বাড়ছে, ভারতের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে বাংলাদেশ

মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলো (মেনা নামে পরিচিত) খাদ্যশস্য আমদানির ক্ষেত্রে কৃষ্ণ সাগরীয় দেশগুলোর বিশেষ করে রাশিয়া ও ইউক্রেনের ওপর বেশি নির্ভরশীল। ফলে চলমান যুদ্ধে এরই মধ্যে ওই অঞ্চলে খাদ্য সরবরাহ সীমিত হতে শুরু করেছে। পরিস্থিতি সামনে আরো অবনমন হবে বলে আশঙ্কা আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষকদের।

কম মূল্যে খাদ্যশস্য আমদানির ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর প্রধান উৎস কৃষ্ণ সাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সেই সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়েছে। ইউক্রেনের বন্দর থেকে জাহাজীকরণ এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের একের পর এক নিষেধাজ্ঞায় অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে মেনাভুক্ত দেশগুলো। উচ্চমূল্যে খাদ্যশস্য আমদানি, অর্থনৈতিক সংকট ও দ্বন্দ্ব সংঘাতেই যেখানে বিপর্যস্ত এসব দেশ, সেখানে খাদ্যশস্যের সরবরাহ সংকট আরো জটিল করবে।

পড়তে পারেন: গম আমদানিতে ঝুঁকছে সরকার, আরও ৫০ হাজার টনের দরপত্র আহ্বান

ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট সংকট মোকাবেলায় কৃষ্ণ সাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর বাইরের উৎস থেকে খাদ্যশস্য আমদানির চেষ্টা করছে মেনা। কিন্তু সেটি তাদের জন্য সহজ হবে না। বৈশ্বিক বাজারে এসব পণ্যের দাম এখন যেমন ঊর্ধ্বমুখী, তেমনি রয়েছে নিষেধাজ্ঞার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রভাব।

ফলে খাদ্যশস্য আমদানিতে বাড়তি মূল্য দিয়েও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা কঠিন হবে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে এখন খাদ্যশস্য আমদানি করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। যে কারণে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলোর প্রত্যেকেই এখন নতুন উৎস দেশের সন্ধানে।

চাষাবাদের জন্য পর্যাপ্ত পানির স্বল্পতা ও উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় মেনা অঞ্চলের আবাদ বাড়ানোর সুযোগ সীমিত। এজন্য খাদ্যশস্যের আমদানির ওপরই বেশি নির্ভরশীল তারা।

পড়তে পারেন: আমদানি কমিয়ে গম উৎপাদন বাড়াতে চায় আলজেরিয়া

আবুধাবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ মনিকা মালিক বলেন, উপসাগরীয় অনেক দেশে খাদ্যশস্যের উদ্বৃত্ত মজুদ রয়েছে। কিন্তু মিসর ও লেবাননসহ মেনার বেশির ভাগ দেশই নাজুক পরিস্থিতিতে রয়েছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে খাদ্যপণ্যের লাগামহীন দাম এসব দেশকে আরো নাজেহাল করবে।

গম আমদানিতে বিশ্বে শীর্ষে মিসর। খাদ্যশস্যটির মোট আমদানির ৮০ শতাংশই আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর উচ্চমূল্যের কারণে দেশটির ক্রেতারা দুটি টেন্ডার বাতিল করেন। এছাড়া দেশটির দুটি কার্গো ইউক্রেনের বন্দরে আটকা পড়ে।

বর্তমানে সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে লেবানন। দেশটিতে এক মাসের মতো গমের মজুদ রয়েছে। খাদ্যশস্যটির ৬০ শতাংশই আসে ইউক্রেন থেকে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ফ্রান্সসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে আমদানির জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে দেশটির সরকার।

বিকল্প উৎস থেকে আমদানি করা সম্ভব না হলে খাদ্যশস্যের সংকট তীব্র হয়ে উঠতে পারে তিউনিসিয়া, সিরিয়া ও মরক্কোসহ অন্যান্য দেশের। এক্ষেত্রেও এসব দেশের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হবে ইউরোপের দেশগুলোর সরবরাহ কমিয়ে দেয়ার ইঙ্গিত। এরই মধ্যে হাঙ্গেরি খাদ্যশস্যের রফতানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। বুলগেরিয়া রফতানির পরিবর্তে মজুদের জন্য উল্টো আমদানির পথে হাঁটছে। ইউক্রেন যুদ্ধের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে একই পথে হাঁটতে পারে অন্যরাও, যা মেনা অঞ্চলের জন্য সুযোগ আরো সীমিত করে দেবে। তীব্র করবে খাদ্য সংকট।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ