ইউসুফ আলী সুমন, নওগাঁ প্রতিনিধি: স্বল্প সময়ের অর্থকরী ফসলের প্রতি ঝুঁকছেন দেশের উত্তরাঞ্চলের খাদ্য ভান্ডার খ্যাত নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার কৃষকরা। চলতি মৌসুমে উপজেলায় রেকর্ড পরিমাণ জমিতে উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাতের গম চাষ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বাম্পার ফলনের আশা করছেন তারা। বাজারে গমের দামও ভাল রয়েছে। এ মৌসুমে অধিক মুনাফ লাভ করতে বারি গম চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উন্নত জাত উদ্ভাবন, উফশী বীজ ব্যবহার, সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং রাসায়নিক সার প্রয়োগে কৃষি খাতে ঘটেছে বিপ্লব। বেড়েছে খাদ্যশস্যের উৎপাদন। স্বল্প সেচে বেশি ফসল উৎপাদন, রাসায়নিক সারের কম ব্যবহার ও অধিক লাভজনক হওয়ায় ‘বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট’ উদ্ভাবিত জাতের গম চাষ করছেন কৃষকরা।

পড়তে পারেন: চাল-গম আমদানি বাড়ছে, ভারতের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে বাংলাদেশ

তুলনামূলকভাবে অন্য জাতের চেয়ে বারি উদ্ভাবিত জাতের গম চাষে রোগবালাই ও পোকামাকড় এর আক্রমণ খুবই কম। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি ২০২১-২০২২ মৌসুমে উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে ৫৬০ হেক্টর জমিতে গমের আবাদ হয়েছে। এ পরিমাণ জমি থেকে ১ হাজার ৯৭১ দশমিক ২ মেট্রিকটন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ।

আব্দুর রহমান, লতিফ উদ্দিন, তারেকুর রহমানসহ ১৫-২০ জন গম চাষি জানান, কম খরচে অধিক আয়ের লক্ষ্যে গম আবাদে ঝুঁকছেন তারা। বোরো ধানের চেয়ে গম চাষে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কম হওয়ায় কৃষকের বিনিয়োগ কম, আয় বেশি। প্রতি হেক্টরে গম চাষে খরচ হয় ২২-২৩ হাজার টাকা; ফলন পাওয়া যায় প্রায় সাড়ে ৩ মেট্রিকটন। গত বছরের মতো এবারও বাম্পার ফলনের আশা করছেন তারা। বর্তমানে বাজারে প্রতিমন গম ১৩০০-১৪০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আগামী ৯-১০ দিনের মধ্যে কাটা-মাড়াই শুরু হবে বলেও জানান চাষিরা।

পড়তে পারেন: গমের চারা কেটে বিক্রি করে বিঘায় পাচ্ছেন ১৮ হাজার

মহাদেবপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ অরুন চন্দ্র রায় জানান, উচ্চ ফলনশীল জাত চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছেন। অন্যান্য ফসলের তুলনায় গম চাষে খরচ কম হওয়ায় কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে। পরামর্শ দেয়ার পাশাপাশি কৃষকরা যেন গম চাষে কোনো সমস্যায় না পড়েন এ জন্য তারা সার্বক্ষণিক নজর রাখছেন। উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রমের প্রত্যাশা করছেন তিনি।

উল্লেখ্য, ভারত থেকে বাংলাদেশে মূলত চাল আমদানি হতো এতোদিন। কিন্তু এখন গম আমদানিও শুরু হয়েছে। অতিমাত্রায় চাল-গম আমদানির কারণে বিরুপ প্রভাব পড়বে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, খাদ্যনিরাপত্তায় ক্রমাগত ভারতের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে বাংলাদেশ।

ভারতের বাজারে সামান্যতম অস্থিরতা দেশে চালের বাজারকে মারাত্মক অস্থিতিশীল করে তোলার ঘটনা অনেকবার ঘটেছে। দেশটিতে আবহাওয়াগত বিপত্তি বা অন্য যেকোনো কারণে চালের বাজারে সরবরাহ কমলে তার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। বর্তমান পরিস্থিতিতে গমের ক্ষেত্রেও একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

পড়তে পারেন: গমের পাতা পোড়া রোগের সমাধান

গত কয়েক দশকে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনে বড় অগ্রগতি হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। যদিও প্রতি বছরই দেশে খাদ্যশস্যের আমদানি বাড়ছে। খাদ্যশস্যের মধ্যে এতদিন মূলত চালই আমদানি করা হতো।

পণ্যটি প্রধানত ভারত থেকেই আমদানি করা হয় বেশি। এখন গম আমদানিরও সিংহভাগ আসছে ভারত থেকে। বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ হলো রাষ্ট্রীয় সংস্থার খাদ্যশস্যের সাফল্য এখনো বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তাকে নিশ্চিত করতে পারেনি। সরকারি-বেসরকারি তথ্য বলছে, বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা এখন অনেকটাই ভারতের ওপর নির্ভরশীল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছর ভারত থেকে ৩৪১ কোটি টাকার কিছু বেশি মূল্যের চাল আমদানি হয়েছিল দেশে। সেখান থেকে প্রায় ২৪ গুণ বেড়ে গত অর্থবছরে খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে প্রায় ৮ হাজার ৫৪১ কোটি ৭০ লাখ টাকার। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই চাল আমদানিতে রেকর্ড পরিমাণ এলসি খোলার বিষয়টি এরই মধ্যে আলোচনায়ও এসেছে।

পড়তে পারেন: গম নিয়ে বিশ্ববাজারে নতুন সংকেত

শুধু চাল নয়, একই চিত্র দেখা যাচ্ছে গমের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশ এখন ভারতে উৎপাদিত গমের শীর্ষ গন্তব্য হয়ে উঠেছে। ভারতীয় বাণিজ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের (ভারতে অর্থবছরের হিসাবায়ন হয় এপ্রিল-মার্চ সময়সীমায়) প্রথম নয় মাসে (এপ্রিল-ডিসেম্বর) দেশটি থেকে গম রফতানি হয়েছে ১৪৩ কোটি ২৮ লাখ ডলারের। এর মধ্যে ৮৪ কোটি ৪৩ লাখ ডলারের গম এসেছে বাংলাদেশে। সে হিসেবে এ নয় মাসে ভারতের মোট গম রফতানির ৫৮ শতাংশেরও বেশি এসেছে বাংলাদেশে।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ