অর্থ-বাণিজ্য ডেস্ক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: ভারত থেকে বাংলাদেশে মূলত চাল আমদানি হতো এতোদিন। কিন্তু এখন গম আমদানিও শুরু হয়েছে। অতিমাত্রায় চাল-গম আমদানির কারণে বিরুপ প্রভাব পড়বে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, খাদ্যনিরাপত্তায় ক্রমাগত ভারতের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে বাংলাদেশ।

ভারতের বাজারে সামান্যতম অস্থিরতা দেশে চালের বাজারকে মারাত্মক অস্থিতিশীল করে তোলার ঘটনা অনেকবার ঘটেছে। দেশটিতে আবহাওয়াগত বিপত্তি বা অন্য যেকোনো কারণে চালের বাজারে সরবরাহ কমলে তার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। বর্তমান পরিস্থিতিতে গমের ক্ষেত্রেও একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

পড়তে পারেন: ভারতে বাড়লো চালের দাম

গত কয়েক দশকে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনে বড় অগ্রগতি হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। যদিও প্রতি বছরই দেশে খাদ্যশস্যের আমদানি বাড়ছে। খাদ্যশস্যের মধ্যে এতদিন মূলত চালই আমদানি করা হতো।

পণ্যটি প্রধানত ভারত থেকেই আমদানি করা হয় বেশি। এখন গম আমদানিরও সিংহভাগ আসছে ভারত থেকে। বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ হলো রাষ্ট্রীয় সংস্থার খাদ্যশস্যের সাফল্য এখনো বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তাকে নিশ্চিত করতে পারেনি। সরকারি-বেসরকারি তথ্য বলছে, বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা এখন অনেকটাই ভারতের ওপর নির্ভরশীল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছর ভারত থেকে ৩৪১ কোটি টাকার কিছু বেশি মূল্যের চাল আমদানি হয়েছিল দেশে। সেখান থেকে প্রায় ২৪ গুণ বেড়ে গত অর্থবছরে খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে প্রায় ৮ হাজার ৫৪১ কোটি ৭০ লাখ টাকার। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই চাল আমদানিতে রেকর্ড পরিমাণ এলসি খোলার বিষয়টি এরই মধ্যে আলোচনায়ও এসেছে।

পড়তে পারেন: মজুদ থেকে গম বিক্রি করবে চীন

শুধু চাল নয়, একই চিত্র দেখা যাচ্ছে গমের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশ এখন ভারতে উৎপাদিত গমের শীর্ষ গন্তব্য হয়ে উঠেছে। ভারতীয় বাণিজ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের (ভারতে অর্থবছরের হিসাবায়ন হয় এপ্রিল-মার্চ সময়সীমায়) প্রথম নয় মাসে (এপ্রিল-ডিসেম্বর) দেশটি থেকে গম রফতানি হয়েছে ১৪৩ কোটি ২৮ লাখ ডলারের। এর মধ্যে ৮৪ কোটি ৪৩ লাখ ডলারের গম এসেছে বাংলাদেশে। সে হিসেবে এ নয় মাসে ভারতের মোট গম রফতানির ৫৮ শতাংশেরও বেশি এসেছে বাংলাদেশে।

ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ আমদানির পরও দেশের খাদ্যপণ্যের বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরানো যাচ্ছে না। বিশেষ করে প্রধান খাদ্যশস্য চালের বাজারে এখনো বেশ অস্থিরতা রয়েছে। এমন অবস্থায় প্রয়োজনে আরো চাল আমদানি করা হবে বলে বক্তব্য দিয়ে চলেছেন সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। ব্যবসায়ীরা পণ্যটি আমদানির জন্য একের পর এক এলসি খোলার আবেদন করে চলেছেন।

পড়তে পারেন: গমের চারা কেটে বিক্রি করে বিঘায় পাচ্ছেন ১৮ হাজার

বর্তমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিষয়টিকে দেশের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক হিসেবে বিবেচনা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, বর্তমান ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারত নিজেও খুব একটা সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে নেই। অস্ত্র ও সামরিক সম্ভারের জন্য দেশটি প্রধানত রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। দেশটিতে এখন রুশ এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

চলমান ইউক্রেন সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের যেকোনো ক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া দেশটিকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে দেশটির জন্য বাণিজ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। এ অবস্থায় খাদ্যশস্যের জন্য ভারত নির্ভরশীলতা দেশের সার্বিক খাদ্যনিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ঠেলে দেয়ার আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে অভিমত ভূরাজনীতির পর্যবেক্ষকদের।

কিছুদিন আগেও গম আমদানিতে কৃষ্ণ সাগরীয় দুই দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেনের ওপর নির্ভরশীল ছিল বাংলাদেশ। ২০১৪ সাল পর্যন্ত দেশে গম আমদানির প্রধান উৎস ছিল ইউক্রেন। এরপর আমদানি খরচ কমাতে রাশিয়া থেকে গম আমদানি বাড়ানো শুরু করে বাংলাদেশ। তবে দেশটিতে সম্প্রতি খাদ্যশস্য রফতানির ওপর শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়। এ অবস্থায় দেশে গমের প্রধান সরবরাহকারীর স্থানে উঠে আসে ভারত। যদিও ঘাটতি পূরণের জন্য চলতি বছর আবারো ইউক্রেন থেকে গম আমদানি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ছিল সরকারের।

পড়তে পারেন: ভারত থেকে গম আমদানি বেড়েছে, কমতে পারে দাম

বর্তমানে রাশিয়া ও ইউক্রেন দুই দেশ থেকেই গম আমদানি প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। ইউক্রেনে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজমান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের বিধিনিষেধের পাশাপাশি ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশভিত্তিক কনটেইনার পরিবহন কোম্পানিগুলোও একে একে রাশিয়ার পণ্য পরিবহন না করার ঘোষণা দিচ্ছে। এ অবস্থায় নিশ্চিতভাবেই গম আমদানিতে ভারতের প্রতি নির্ভরশীলতা আরো বাড়তে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

দ্য চিটাগং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম জানান, রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধ গোটা বিশ্ববাজারেই প্রভাব ফেলেছে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজারে পণ্যটির দাম বাড়লেও দেশে গমের সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা তেমন একটা নেই। কারণ গম আমদানিতে রাশিয়া-ইউক্রেনের পরিবর্তে এখন ভারতনির্ভরতা বেড়েছে। আমদানীকৃত গমের প্রায় ৮০ শতাংশই আসছে ভারত থেকে। মাঝে ভারতীয় গমের দাম কমলেও বর্তমানে কিছুটা বাড়তে শুরু করেছে।

ভারতের স্থানীয় বাজারে গমের সরবরাহ বরাবরই চাহিদার চেয়ে বেশি। তবে এশিয়ার বাইরে বাজার সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে দেশটি এর সুবিধা কতটা কাজে লাগাতে পারবে, সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে পর্যবেক্ষকদের। ইউরোপে কৃষিপণ্য রফতানিতে নিয়মকানুনের কড়াকড়ি ও নীতিগত অনুমোদনের প্রক্রিয়াটি বেশ সময়সাপেক্ষ। অন্যদিকে রাশিয়ার ওপর একের পর এক বিধিনিষেধ দিলেও পশ্চিমা দেশগুলো এখন পর্যন্ত দেশটির সঙ্গে গম বাণিজ্য চালু রেখেছে।

পড়তে পারেন: বিশ্বের শীর্ষ চাল আমদানিকারক হতে পারে ফিলিপাইন

তবে বাংলাদেশসহ এশিয়ার বাজারে এর সুবিধা নেয়ার পথে কোনো বাধা নেই ভারতের সামনে। এখন পর্যন্ত ভারতীয় গমের প্রধান গন্তব্য মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। তবে ভারতীয় গমের রফতানি গন্তব্য হিসেবে এ মুহূর্তে অন্য কোনো দেশ বাংলাদেশের ধারেকাছে নেই। দেশটির গম রফতানিতে দ্বিতীয় শীর্ষ গন্তব্য শ্রীলংকার অংশ ৮ শতাংশের কিছু বেশি। যেখানে বাংলাদেশে তা ৬০ শতাংশের কাছাকাছি।

এ মুহূর্তে দেশটি থেকে গম আমদানি আরো বাড়ানোর কথা ভাবছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে সম্প্রতি ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশী হাইকমিশনের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা সম্প্রতি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম মানিকন্ট্রোলকে বলেছেন, রাশিয়া থেকে গমের সরবরাহ বন্ধ হয়ে পড়েছে। দেশটি থেকে নতুন করে আমদানির সুযোগ নিয়েও রয়েছে আশঙ্কা। এতে করে বাংলাদেশ এরই মধ্যে গমের দাম বেড়ে রেকর্ড পর্যায়ে উঠেছে। এ অবস্থায় অদূরভবিষ্যতে ভারত থেকে বাংলাদেশে গম আমদানি আরো বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি এক প্রকার নিশ্চিতই বলা চলে।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ