ড. মোঃ মাহফুজ আলম, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: বর্তমানে বাংলাদেশ আলু হেক্টরপ্রতি গড় ফলন মাত্র ১১ টন। আলুর উৎপাদন ২০ টন পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। ফলন বাড়লে উৎপাদন খরচ কমে আসবে। কিন্তু বিপুল পরিমাণ আলু চাষে চাষিরা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। আলুর রোগ বালাই, সেঁচ, শ্রমিক সংকটসহ বেশ কিছু পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়। এরমধ্যে রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিকার ব্যবস্থা জানলে ক্ষতি কমিয়ে ফলন বাড়ানো সম্ভব হয়। আলু চাষে প্রত্যেক চাষিকে আলুর লেট ব্লাইট বা নাবী ধ্বসা রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।

আলুর লেট ব্লাইট বা নাবী ধ্বসা রোগ

Phytopthora infestans নামক ছত্রাকের আক্রমনে এ রোগ হয়ে থাকে। প্রতি বছর আমাদের দেশে এ রোগের কারণে ব্যাপক ক্ষতি সাধতি হয়। এটি আলু ও টমেটোর সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতকিারক রোগ। এ রোগের কারণে ১৮৪৫ সালে আয়ারল্যান্ডে দূর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল, ফলে প্রায় একলক্ষ লোকের মৃত্যু হয় এবং দুই লক্ষ লোক ইউরোপ থেকে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছিল। প্রাথমিক রোগ নির্ণয় ও দমন ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব কমানো যায়।

রোগের লক্ষণ
রোগের আক্রমনের প্রথমে পাতায় হালকা থেকে গাঢ় সবুজ রঙের বৃত্তাকার বা অনিয়মিত আকারের পানি ভেজা দেখা যায়। সাধারণত এই রোগের লক্ষণ প্রথমে পাতার নিচের অংশে দেয়া যায়। কখনও কখনও পাতার শেষ প্রান্ত (leaf tip) বা পাশে (edge) এ রোগের লক্ষণ শুরু হয় ।

ঠান্ডা ও আর্দ্র আবহাওয়ায়, যেখানে শিশির দীর্ঘ সময় থাকে এই ক্ষত দ্রুত বড় হয়ে গাঢ় বাদামী বা কালো দাগে পরিনত হয় । মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে এই দাগ শুধুমাত্র পাতার শিড়ায় সীমাবদ্ধ না থেকে নতুন সংক্রমন শুরু হয় এবং কয়েকটি দাগ একত্রিত হয়ে সমস্ত পাতা পুড়ে যায় । পাতার নীচের অংশে সাদা পাউডারের মত অসংখ্য জীবানু লেগে থাকতে দেখা যায়।

এই রোগ ক্রমান্বয়ে পাতা থেকে বোটা ও কান্ডে বিস্তার লাভ করে। অনুকুল আবহাওয়ায় সমস্ত গাছ কালো হয়ে ঢলে পড়ে এবং ২-৩ দিনের মধ্যে সমস্ত মাঠের গাছ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। গাছের উপরের অংশ আক্রান্ত হওয়ায় মাটির নীচে আলু ও আক্রান্ত হয়। আলুর চামড়ায় হালকা থেকে গাঢ় বাদামী রঙের দাগ দেখা যায়। এই দাগ পরবর্তীতে বাদামী থেকে বেগুনী রঙের হয় এবং আক্রান্ত অংশ ফুলে উঠে এবং এই পচা অংশ পরবর্তীতে শুকিয়ে যায়।

এগ্রিকেয়ার২৪.কমের আরোও নিউজ পড়তে পারেন:

আলুর মড়ক রোগ প্রতিরোধের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাপনা

আলুর পাতা মোড়ানো রোগের লক্ষণ ও সমাধান

সরিষা চাষ করে আলুর বাদামি পচা রোগ প্রতিকারের কৌশল

আলুর কালো দাগ ও অন্তর ফাঁপা রোগ দমনে করণীয়

অনুকুল আবহাওয়া

আমাদের দেশে সাধারনত শীতকালে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী মাসের যে কোন সময় নিম্নতাপমাত্রা (রাতে ১০-১৫.৫ এবং দিনে ১৫.৫-২১০ সেলসিয়াস), উচ্চ আর্দ্রতা (৮০% এর বেশী), কুয়াশাচ্ছন্ন মেঘলা আবহাওয়া এবং গুড়ি গুড়ি বৃষ্টতিে এ রোগ মহামারী আকার ধারন করে। বাতাস, বৃষ্টি ও সেচের পানির সাহায্যে এ রোগের জীবানু দ্রুত আক্রান্ত গাছ থেকে সুস্থ গাছে বিস্তার লাভ করে।

রোগ প্রতিরোধের উপায়

১। রোগমুক্ত জমি হতে শুকনা আলু বীজের জন্য সংগ্রহ করতে হবে।
২। ফসল উঠার পর জমির আক্রান্ত গাছের পরিত্যক্ত অংশসমূহ পুড়ে ফেলতে হবে।
৩। গাছের গোড়ার মাটি উচু করে দিলে মাটির নীচে আলুকে রোগজীবানু আক্রমণ করতে পারে না।
৪। আলু ও টমেটো ছাড়া জমিতে অন্য ফসল যমেন ধান দয়িে শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে।
৫। বৃষ্টির পর বা মাটি ভিজা অবস্থায় কখনও আলু উঠানো উচিৎ নয়।
৬। হিমাগারে আলু রাখার আগে রোগমুক্ত আলু বাছাই করে রাখতে হবে।
১. আক্রান্ত জমিতে রোগ নিয়ন্ত্রণ না হওয়া পর্যন্ত সেচ প্রদান বন্ধ রাখতে হবে।

রোগ হওয়ার পর করণীয়

জমিতে রোগ দেখা দিলে ৪/৫ দিন পর পর নিম্নবর্ণিত গ্রুপের যে কোন ছত্রাকনাশক বা পর্যায়ক্রমে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করে গাছ ভালভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে:
১. সিকিউর ৬০০ ডব্লিউজি (ম্যানকোজেব ৫০% + ফেনমিডন ১০%) অথবা
২. এক্রোবেট এম জেড (ম্যানকোজেব ৬০% + ডাইমেথোমর্ফ ৯%) অথবা
৩. মেলোডি ডুও ৬৬.৮ ডব্লিউপি প্রোপিনের ৭০% + ইপ্রোভেলিকার্ব) ৪ গ্রাম +সিকিউর ৬০০ ডব্লিউজি ১ গ্রাম।

সতর্কতা

গাছ ভেজা অবস্থায় জমিতে ছত্রাকনাশক স্প্রে না করা। যদি স্প্রে করতেই হয় তাহলে ছত্রাকনাশকের সাথে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে সাবানের গুড়া মিশিয়ে দিতে হবে। ছত্রাকনাশক স্প্রে করার সময় হাত মোজা, সানগ্লাস, মাস্ক ও এপ্রোন ব্যবহার করতে হবে। সব সময় বাতাসের অনুকুলে স্প্রে করতে হবে। সাধারণ স্প্রেয়ারের পরিবর্তে পাওয়ার স্প্রেয়ার ব্যবহার করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।

১. প্রথমে ছোট, হালকা থকেে গাঢ় সবুজ, বৃত্তাকার থকেে অনিয়মিত আকৃতির পানি ভেজা দাগ দখো যায় ।

২. ক্ষতগুলি দ্রুত বড়, গাঢ় বাদামী বা কালো ক্ষতে পরিণত হয়।

৩. পাতার নিচে অংশে পাউডারী মিলডিউ যায় ।

৪. ক্ষত গাছের বোঁটা ও কান্ডে হতে পারে।

আলুর লেট ব্লাইট বা নাবী ধ্বসা রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার লেখাটি লিখেছেন ড. মোঃ মাহফুজ আলম, প্রধান বৈজ্ঞানিক র্কমর্কতা, শস্য বিভাগ , বি এ আর সি , ঢাকা।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ