ডেস্ক প্রতিবেদন, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: করোনায় ক্ষতিগ্রস্থ ৬৯ ভাগ মৎস্যচাষি সামনের দিনে বেঁচে থাকার জন্য ঋণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। ১৪ শতাংশ তাদের বিকল্প আয়ের উৎসের ওপর নির্ভর করার কথা বলেছেন। ১৮ শতাংশ তাদের সঞ্চয় ভেঙে বা সম্পদ বিক্রি করে চলার কথা বলেছেন। আর ১৮ শতাংশ জানিয়েছেন তাদের কোনো পরিকল্পনা নেই। ৫ শতাংশ বলেছেন, উৎপাদনে না ফিরতে পারলে তারা পেশাই বদলে ফেলবেন।
ত্রাণবহির্ভূত ও পচনশীল পণ্যগুলোর উৎপাদন অব্যাহত রাখা এবং বিক্রি করা কঠিন হওয়ার কারণে ৮৮ শতাংশ কৃষক (মাছচাষীদের ১০০) আর্থিক ক্ষতির কথা জানিয়েছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার ৪ জুন ২০২০ বিকালে এক ডিজিটাল সংবাদ সম্মেলনে কৃষি খাতে এবং সামগ্রিক খাদ্যনিরাপত্তার ওপর কভিড-১৯-এর প্রভাব গবেষণার আওতায় করা দুটি সমীক্ষার ফলাফল তুলে ধরে ব্র্যাক। গবেষণায় সারা দেশের ১ হাজার ৫৮১ জন কৃষক (ফসল, শাকসবজি, হাঁস-মুরগি, মাছ ও দুগ্ধ উৎপাদনকারী) এতে অংশগ্রহণ করেন। মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে মে মাসের প্রথম দিক পর্যন্ত এ ক্ষতির হিসাব উঠে এসেছে।
সমীক্ষায় বলা হয়, এই দেড় মাসে পণ্যের ক্ষতি ও কম দামের কারণে প্রত্যক কৃষকের লোকসান হয়েছে গড়ে প্রায় ২ লাখ ৭ হাজার ৯৭৬ টাকা। সেই হিসাবে সারা দেশে কৃষির প্রতিটি উপখাতের সব কৃষকের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে লোকসান দেখানো হয়েছে ৫৬ হাজার ৫৩৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে শস্য খাতে ১৫ হাজার ২৫০ কোটি টাকা, মত্স্য খাতে ৩৮ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা, পোলট্রি খাতে ১ হাজার ৭৬৯ কোটি এবং প্রাণিসম্পদ খাতে প্রায় ৫৮৫ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে কৃষকের।
৬৬ শতাংশ কৃষক সহজ শর্তে ঋণ পেতে চান। ৫৬ শতাংশ কৃষক উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম চার। কম খরচে উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ চান ৪৮ শতাংশ কৃষক। সমীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত ৬৪ শতাংশ কৃষক সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা সম্পর্কে জানেন। তবে এই সুবিধা কীভাবে পাওয়া যায় সে সম্পর্কে ৭৯ শতাংশ কৃষকের কোনো ধারণা নেই বা ভুল ধারণা আছে। ব্যাংক থেকে আনুষ্ঠানিক ঋণ নেয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ কৃষকের।
ব্র্যাকের এ গবেষণা বলছে, কভিড-১৯-এর প্রভাবে দেড় মাসে কৃষকের ক্ষতি হয়েছে ৫৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি। শস্য খাতে প্রায় ১৫ হাজার এবং মৎস্য খাতে ৩৯ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এতে গড়ে প্রতিজন কৃষকের লোকসান হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৭ হাজার টাকা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কৃষি খাতে প্রণোদনা বাড়াতে হবে। ক্ষতির মুখে পড়া কৃষকদের চলতি মৌসুমে সস্য রোপণে বীজ, সার, কীটনাশকসহ অন্যান্য আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের নায্যমূল্য প্রদানে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অল্পদামে কৃষিপণ্য না বেঁচতে কৃষকদের উৎসাহিত করা এবং গুদামজাতকরার ব্যবস্থা করা।
ব্রাকের এ গবেষণায় দেখা যায়, মহামারী শুরুর দিকে ত্রাণ বিতরণকারী সংস্থাগুলোর ব্যাপক চাহিদা এবং ভোক্তাদের আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পণ্য কেনার কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, বিশেষ করে মোটা চাল, মসুরের ডাল ইত্যাদির দাম ও বিক্রি বেড়ে যায়। চাল ও মসুরের ডালের দাম ৩০ থেকে ৩২ শতাংশ এবং ব্যবসায়ীদের এই পণ্যগুলোর বিক্রি ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। বাজারে চাহিদা বাড়লেও তা কৃষকদের কোনো উপকারে আসেনি। কারণ মহামারীর আগেই তারা তাদের মজুদ বিক্রি করে দিয়েছিলেন।
কৃষকরা যেসব সমস্যার কথা বলেছেন তার মধ্যে সবার আগে উল্লেখযোগ্য হলো পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া। প্রায় ৬৬ শতাংশ কৃষকই পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাননি। সীমিত সময়ের জন্য বাজার খোলা থাকার কারণেও ক্ষতি হচ্ছে, এমন কৃষকের সংখ্যা ৫২ শতাংশ। উৎপাদনের উপকরণের উচ্চমূল্য, এমন দাবি করেছেন ৪৫ শতাংশ এবং শ্রমিক সংকটের কথা বলেছেন ২৮ শতাংশ কৃষক।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, তথ্য প্রদানকারী কৃষকদের ৪২ শতাংশ কৃষক জানিয়েছেন, সংকট মোকাবেলার কোনো উপায় তাদের ছিল না। খাদ্যশস্য ও সবজি উৎপাদনকারী ৬০ শতাংশ কৃষক বলেছেন যে তাদের সম্পূর্ণ লোকসানই মেনে নিতে হয়েছে। মোট কৃষকের ১১ শতাংশ এবং পোলট্রি কৃষকের মধ্যে ১৭ শতাংশ তাদের উৎপাদন কমিয়েছিলেন। উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন ২ শতাংশ খামারি।
মুরগির দাম শুরুতে কমে গেছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। চাহিদা কমার কারণে পোলট্রি খামারিরা উৎপাদনও কমিয়ে দেন। এতে সরবরাহের ঘাটতি দেখা দেয়ার কারণে পরে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। দুগ্ধ উৎপাদনকারী কৃষকের পণ্যের চাহিদা ৩৩-৬০ শতাংশ হ্রাস পায় এবং খুচরা স্তরে (কৃষক পর্যায়ে ২২ শতাংশ) গড়ে দাম ১২.৫ শতাংশ কমে যায়। দুগ্ধ উৎপাদনকারী কৃষকদের ১৬ শতাংশ তাদের উৎপাদন কমিয়ে দেন।
গতকাল ব্র্যাকের এ গবেষণার ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এমএ সাত্তার মন্ডল, প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াস মৃধা, এসিআই এগ্রিবিজনেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী পরিচালক ড. ফা হ আনসারী ও ব্র্যাকের ডেইরি অ্যান্ড ফুড এন্টারপ্রাইজের পরিচালক মোহাম্মদ আনিসুর রহমান। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ব্র্যাকের অ্যাডভোকেসি ফর সোস্যাল চেঞ্জ কর্মসূচির ঊর্ধ্বতন পরিচালক কেএএম মোর্শেদ।
করোনায় ক্ষতিগ্রস্থ ৬৯ ভাগ মৎস্যচাষি ব্যাংক ঋণ চান শিরোনামে সংবাদের তথ্য বণিক বার্তা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
