মেহেদী হাসান, নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করেছেন ২০১১ সালে। মেধার জোরে এমবিএ চলাকালীন সময়েই জুটিয়ে নেন আবুল খায়ের কোম্পানির বড়োসড় পোস্ট। চাকরিতে মন বসে না; কারোও অধীনস্ত ভালো লাগে না রবিউল করিমের। তাই চাকরি ছেড়ে হয়েছেন গরুর খামারি। এখন গরু পালন করেই মাসে আয় করছেন দেড় লাখ টাকা!

“চাকরি করে কি করব বলেন? পরের অধীনস্ত হয়ে থাকতে ভালো লাগেনা। নিজের মেধা দিয়ে পরের কোম্পানি গড়ে দিব কেন? আমার ইচ্ছা, আমি নিজেই একটা কোম্পানি করব। দশটা মানুষের কর্মসংস্থান হবে; এটাই আমার সুখের জায়গা। এখন আমার বছরে ১৫ থেকে ১৮ লাখ টাকা আয় হয়। প্রতিমাসে লাখ টাকার উপরে আয় তো আর কম নয়, চাকরি করে এতো টাকা পেতাম না।”-এভাবেই বলছিলেন তরুন উদ্যোক্তা রবিউল করিম।

গত মঙ্গবার (২২ জুন ২০২১) তাঁর খামারে গিয়ে দেখা যায় দুধ সংগ্রহের জন্য পাত্র প্রস্তুত করা হচ্ছে। চারিদিকে গরুর হাম্বা-হাম্বা ডাক। রবিউল থাকেন রাজশাহীর কাটাখালী শ্যামনগর এলাকায় কিš ‘ নিজের বাসা থেকে কিলোমিটার খানেক দূরে গড়ে তুলেছেন “আবরার ডেইরি ফার্ম”। যেখান থেকে প্রতিদিন দেড়’শ লিটার দুধ রাজশাহীর বিভিন্ন মিষ্টির দোকান ও ভোক্তার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। গুণে ও মানে ভালো দুধ পেয়ে খুশি আশেপাশের খুচরা ক্রেতারাও।

পড়তে পারেন: শূন্য থেকে কোটিপতি আরাফাত রুবেল

২০১১ সালে এমবিএ করাকালীন সময়ে লোভনীয় চাকরি ছেড়ে শুরু করেন ছাগলের খামার। কিন্তু বিধি বাম! ছাগলের খামার বছরের মাথায় ছেড়ে দিলেন। খেয়াল করলেন রাজশাহীতে গরুর খাঁটি দুধের খুব আকাল। সেই থেকেই দুধের ব্যবসা করার মনস্থির করে ফেললেন।

একজন এমবিএ ডিগ্রিধারী গরু কিনে দুধ বেচবেন, তা নিয়ে প্রতিবেশীরা ঠাট্টা করেননি এমনটি নয়! তবে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এগিয়ে চলছেন রবিউল। এরপর চারটি গাভী কিনলেন দেড় লাখ টাকায়। সেই থেকে খামারে বাড়ছে গরুর সংখ্যা। বর্তমানে গরুর সংখ্যা ৩২। ১৩টি গরু দুধ দিচ্ছে দেড়’শ লিটারের বেশি।

করোনাকালে ডেইরি খামারিদের লোকসান হয়েছে সর্বাধিক। রবিউল করিমের যে লোকসান হয়নি তা নয়। তবে, তা বুদ্ধি দিয়ে উতরে গেছেন। অবিক্রিত দুধ ছানা তৈরি করে রাখছেন ফ্রিজে। সেখান থেকে বিক্রি করছেন মিষ্টির দোকানে। পরিকল্পনা করেছেন রাজশাহী নগরীর নিউ মার্কেট এলাকায় দুগ্ধজাত পণ্যের দোকান দেবেন।

পড়তে পারেন: হাঁসের খামার করে লাখপতি নওগাঁর খালেক

তিনি এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, “করোনায় এখন দুধের দামে লোকসান। উৎপাদন খরচ উঠছে না। বছর শেষে বাছুরের দাম যা পাওয়া যাবে তা দিয়েই এ বছর শেষ। গত বছরে করোনার শুরুতে লোকসান; তারপর একটু বাজার ভালো হতে না হতেই আবার ধস। সব মিলিয়ে এই খাত লোকসান থেকে উঠতে পারছে না।”

ডেইরি খামারের প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডেইরি খামার হোক কিংবা মাংস উৎপাদনকারী খামার হোক সব খামারের কিছু সমস্যা থাকে। ডেইরি খামারে মিল্ক ফেভার (দুগ্ধ জ্বর) হয়। তার চেয়ে বড় সমস্যা ক্ষুরা রোগ। এই রোগগুলো থেকে বাঁচতে খামার পরিস্কার রাখতে হবে; খামারের জন্য গরু কেনার আগে গরু দেখতে হবে বাইরের গরু কিনা, কৃমিনাশক, স্কিন ডিজিজ থেকে বাঁচে টিকা দিতে হবে। রাজশাহীতে বর্ডার থাকার কারণে ইন্ডিয়ান গরু বেশি পাওয়া যায়। ক্ষুরা রোগ ছোঁয়াচে হওয়ায় দ্রুত সংক্রমিত করে ফেলতে পারে। তাই সতর্ক থাকতে হবে আর বেশিরভাগ রোগ উপযুক্ত চিকিৎসায় ভালো হয়। খামারের যেকোন সমস্যায় সর্বক্ষণিক প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে।

রবিউলের খামার দেখাশুনার জন্য ২ জন কর্মচারী কাজ করেন। তারা দুধ দোহন করা, খাবার দেওয়া, গরুকে গোসল করানো থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ করেন। দু-জনের বেতন দিতে হয় ৩০ হাজার টাকা। গরুকে খাওয়ানোর জন্য ৪ বিঘা জমিতে উন্নত জাতের নেপিয়ার ঘাস লাগিয়েছেন তিনি। ভুট্টা, গম, ধানসহ দানাদার খাবার নিজেই নির্দিষ্ট অনুপাতে তৈরি করেন। ফলে উৎকৃষ্ট মানের খাবারের সাথে সাথে দামও পড়ে কম, মাত্র ২৫ টাকা কেজি!

পড়তে পারেন: এইচএসসি পড়ুয়া সজীবের মুরগির খামার, মাসিক আয় ৪০ হাজার

নতুন খামারিদের পরামর্শ হিসেবে রবিউল বলেন, চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হওয়া ভালো। গরুর খামার করে লোকসানের কথা ভাবা যায় না। শুধুমাত্র সঠিক পরিকল্পনা আর দৃঢ় মনোবল থাকলে এগিয়ে যাওয়া যায়। কৃষিকাজ, পশুপালন শিক্ষিতদের জন্য। একদিকে যেমন স্বাবলম্বী হওয়া যায় সেইসাথে ২-৫ জনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়।

রাজশাহী মেট্রো প্রাণিসম্পদ হাসপাতালের পশু চিকিৎসক ফজলে রাব্বি এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে জানান, রবিউল করিম ও আরাফাত রুবেল দক্ষ খামারি। উভয়ে-উভয়ের খামারে যাওয়া আসা করে, পরামর্শ করে কাজ করে। আমাদের প্রয়োজন হলে ফোন করলে আমরা যাই। প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করি।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ