সাহেদুল আলম রোকন, নাটোর প্রতিনিধি, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: উত্তরাঞ্চলের শস্য ভান্ডারখ্যাত নাটোরে নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে অপরিকল্পিতভাবে ফসলি জমিতে পুকুর খনন চলছে। খনন করা মাটি যাচ্ছে ইট ভাটায়। কমছে কৃষি জমি। তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতার। এতে সমস্যায় পরছেন কৃষকেরা।

এমন চিত্র এখন নাটোর জেলার পুরো এলাকাতে। অভিযোগ দিয়ে প্রতিকার না পাওয়ায় বিক্ষুদ্ধ জনতা পুড়িয়ে দিয়েছে মাটি খননের কাজে ব্যবহৃত এক্সকেভিটর মেশিন (ভেকু)। স্থানীয় প্রশাসনে পদক্ষেপে দুই একদিন বন্ধ থাকার পর ফের পুরোদমে চলে কৃষি জমিতে পুকুর খননের কাজ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার ৭টি উপজেলাতেই কমবেশী এমন অপরিকল্পিতভাবে চলছে পুকুর খনন। জমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ ফসলি জমিতে পুকুর খনন করতে হলে স্থানীয় প্রশাসসনের অনুমোদন লাগার কথা আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও এসবের তোয়াক্কা করছে না পুকুর খননে নিয়োজিত এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা।

এই অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খননের জের সরাসরি পরছে কৃষি জমি ও কৃষকের ওপর। একদিকে কমছে কৃষি জমি অন্যদিকে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে চাষাবাদ করা কঠিন হয়ে পরেছে। এতে ক্ষতির সম্মুখিন হতে হচ্ছে কৃষকদের।

বড়াইগ্রাম উপজেলার ধারাবারিষা চেচুয়ার বিলের মাঝ বরাবর উচু করে পুকুর খনন করায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টির আশংকা করছেন এলাকাবাসী। এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়ে প্রতিকার পাচ্ছেন না তারা। নাটোর সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানেও একই অবস্থা। শংকরভাগ বাজারের দক্ষিণে মাউত বিলে অনেকক গুলো পুকুর কাটার ফলে বিলের পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতার আশংকা করছেন এলাকাবাসী।

গুরুদাসপুর উপজেলার বিয়াঘাট ইউনিয়নের দুর্গাপুর-বাবলাতলা গ্রামের কৃষক শীতল, হারু প্রামানিক, শাহাদত ও শামীমের হাঁড়িভাঙ্গা বিলের প্রায় ১১ বিঘা জমি লিজ নিয়ে পুকুর খনন শুরু করছেন একই গ্রামের বদর আলী। পাশের ৯ বিঘা জমিতে আরেকটি পুকুর খনন চলছে। হাঁড়িভাঙ্গা বিলে জমি আছে এমন ১৪/১৫ জন কৃষক বলেন, বিল এলাকায় কমপক্ষে ২০টি পকুর খনন করা হয়েছে।

আরও ১০টি পুকুর খননের কাজ চলছে। এর মধ্যে ফিরোজ তালুকদারের ১৪ বিঘা ও ছয় বিঘার দুটি, নজরুল ইসলামের ১২ বিঘা। এমনকি মিজানুর রহমানের ১০ বিঘা জমির পুরোটাতেই চলছে পুকুর খনন। এমনি ভাবে পুকুর খননের মহাৎসব চলছে জেলার প্রায় সব এলাকায়।

পুকুর খনন বন্ধের দাবিতে স্থানীয় জমির শতাধিক মালিক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। কিন্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তেমন কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় নি। ফলে উত্তেজিত জনতা গত ২৩ মার্চ রাতে মাটি কাটার জন্য ব্যবহৃত দুটি এক্সকেভিটর মেশিন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন। এরপরেও গুরুদাসপুরে থেমে নেই মাটি কেটে পুকুর খনন।

এ বিষয়ে গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইয়াসমিন আক্তার এগ্রিকেয়ার২৪.কম কে বলেন, কৃষিজমিতে পুকুর খননের সুযোগ নেই। কেউ পুকুর করতে চাইলে জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করে জমির শ্রেণী পরিবর্তনের অনুমতি প্রয়োজন। কিন্ত হাঁড়িভাঙ্গা বিলে পুকুর খননকারীরা সেই নিয়ম অনুসরণ করেন নি।

তিনি জানান, কৃষকদের লিখিত অভিযোগ পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এর সত্যতা পেয়েছেন। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি পুকুর খনন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন।

এছাড়া সিংড়া উপজেলার পুঠিমারী, কুশাবাড়ী, নীলচরা, পাটকান্দি, সোনাপুর, মঠগ্রাম, ধুলিয়াডাঙ্গা, বড়শাঔল, নলবাতা, দীঘলগ্রাম, চৌগ্রাম, আরকান্দিসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে সব খানেই তিন ফসলি ও দুই ফসলি জমিতে পুকুর খনন করতে দেখা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব পুকুর খননের সাথে জড়িত রয়েছেন রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধিসহ প্রভাবশালীরা।

প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া লালপুর উপজেলার দুড়দুড়িয়া, ওয়ালিয়া, দুয়ারিয়া, কদিমচিলান ইউনিয়নে চলছে পুকুর খনন। লালপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাবিবুল ইসলাম এগ্রিকেয়ার২৪.কম কে বলেন, এভাবে পুকুর খনন চলতে থাকলে লালপুরে আবাদি জমি একেবারে কমে যাবে।

লালপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার নজরুল ইসলাম সরেজমিনে গিয়ে তদন্ত সাপেক্ষে আবাদি জমিতে পুকুর খনন করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাষ দেন।

নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রফিকুল ইসলাম এগ্রিকেয়ার২৪.কম কে বলেন, নাটোরের মত উর্বর তিন ফসলী জমি দেশের কম জায়গাতে আছে। এখানে প্রচুর পরিমান ডালজাতীয় ফসল, মসলা জাতীয় ফসল ছাড়াও ধান, গম, আখসহ বিচিত্র ফসলের আবাদ হয়। জেলার পেয়ারা, আম এবং ড্রাগন সারাদেশে খুবই সমাদৃত।

তিনি বলেন, যেভাবে আবাদি জমি কমছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো তা ধরে রাখা সম্ভব হবে না। ইটভাটা মালিকদের প্রলোভনে পড়ে কৃষকরা আবাদি জমিতে পুকুর কেটে ভাটাতে মাটি বিক্রি করছেন বলেও জানান তিনি।

নাটোরের জেলা মৎস কর্মকর্তা অলক কুমার সাহা এগ্রিকেয়ার২৪.কম কে জানান, মাছ চাষকে কোন ভাবেই অবহেলা করার সুযোগ নেই। তবে তা পরিকল্পিত এবং আইন মেনে হতে হবে। নাটোরে যেভাবে অপরিকল্পিত পুকুর খনন হচ্ছে তাতে মাছ চাষের যেমন ক্ষতি হচ্ছে একইভাবে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে।

নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন এগ্রিকেয়ার২৪.কম কে জানান, মানুষ কেন বুঝতে চাচ্ছে না যে আবাদি জমি কমে গেলে তাদের জীবন সংকটাপন্ন হবে। আবাদি জমি রক্ষা করার ব্যাপারে মন্ত্রনালয়ের সাথে কথা হয়েছে। ফসলি জমিতে পুকুর খনন কঠোর হাতে দমন করা হবে।