মাহমুদুন্নবী, পত্নীতলা (নওগাঁ) প্রতিনিধি: কাগজ কলমেই যেন আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি! দিনে দিনে কমছে খাল-বিল, তলানিতে ঠেকছে দেশীয় মাছের উৎপাদন। যেসব নদী বা খাল রয়েছে তাও আবার বিভিন্ন বিষাক্ত বর্জ্যে দূষিত। যার ফলে মাছের স্বাভাবিক প্রজনন ব্যহত হচ্ছে। ফলে সংখ্যা বৃদ্ধির অনকূল পরিবেশ না পাওয়ায় পাত থেকে উঠে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন মাছ।

তবে আশার দিকও রয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) বিলুপ্তপ্রায় ৪০ প্রজাতির মাছের সফল প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন ও চাষ পদ্ধতি আবিস্কার করেছেন। হারিয়ে যাওয়া এসব মাছ আবারও পাতে দেখা মিলবে বলেই আশা করা হচ্ছে।

এক সময় নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলার বিভিন্ন খাল- বিল, পুকুর- জলাশয় ও নদী থেকে বিভিন্ন প্রজাতির প্রচুর মাছ পাওয়া যেতো। কিন্তু প্রাকৃতিক আবাসভূমি দ্রুত বদলে যাচ্ছে। বিলুপ্তের ঝুকিতে থাকা এসব মাছের অব্জল ভেদে বিভিন্ন নাম রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে চাঁদা, নামা চাঁদা, গোল চাঁদা, আইড়, শুলশা, পাবদা, দেশি পুঁটি, সরপুঁটি, বাইলা, ভেদা, মাগুর, বোয়াল, শিং, কৈ, টাকি, শোল, ফলি, চেলা, মলা, ঢেরা, ছোট টেংরা, বড় টেংরা, চান্দা, চ্যাং, ছোট চিংড়ি, বাতাশি,দেশি জাতের পটকা, বেলেসহ নাম না জানা আরো বিভিন্ন প্রজাতির মাছ।

পড়তে পারেন: লাল তেলাপিয়ায় মিলছে সফলতা, যেভাবে চাষ করবেন

এক সময় দেশি জাতের এসব ছোট মাছের উৎস ছিলো খাল- বিল, পুকুর-জলাশয় ও বিভিন্ন নদী- নালা। পত্নীতলা উপজেলার বড় বিল,বেকি বিল, বুড়িদহ বিল, ঘুকসি বিল, সাত বিলা বিল ও উপজেলার মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া আত্রাই নদী থেকে এক দশক আগেও প্রতিদিন উপজেলার নজিপুর মাছ বাজারসহ বিভিন্ন হাট- বাজারে দেশি জাতের পর্যাপ্ত ছোট মাছ আসতো।

উপজেলার বড় বিল, বেকি বিল, বুড়িদহ বিল, ঘুকসি বিল, সাত বিলা বিল ও আত্রাই নদী দখল আর দূষণের কবলে পড়ে অস্বিত্ব প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। চাহিদা থাকার সত্বেও ক্রেতারা এখন এ জাতীয় মাছের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

পত্নীতলা উপজেলার প্রবীন গন্যমান্য ব্যক্তিরা বলেন, এখন তো দেশি প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়না বললেই চলে। এখন পুকুরে রুই, কাতলা, মৃগেল, পাঙ্গাস, তেলাপিয়া,সরপুঁটি, কৈ, মাগুর, শিং,পাবদা ইত্যাদি প্রজাতির মাছ চাষ করা হচ্ছে। এতে দেশে মাছের চাহিদা হয়তো বা পূরণ হচ্ছে কিন্তু দেশীয় মাছের যে স্বাদ ও পুষ্টি তা থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি।

পড়তে পারেন: মাছ চাষে ফিডের পরিবর্তে ঘাস ব্যবহার পদ্ধতি

অথচ এক দশক আগেই কোন রকম চাষ ছাড়াই আমাদের গ্রামাঞ্চলে এক সময় প্রচুর পরিমানে দেশীয় জাতের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাওয়া যেতো। বাজারগুলোও ভরে যেতো দেশি মাছে যা খেয়ে তৃপ্তি পাওয়া যেতো। খাল- বিল, জলাশয়ের অধিকাংশ এলাকায় নতুন নতুন ঘর- বাড়ি গড়ে উঠায় জলাশয় ও খাল- বিলের অস্বিত্ব নেই।

তারা আরো জানান, তাছাড়া ছোট জাতের মাছের সরবরাহ অনেক হ্রাস পেয়েছে। দুটি কারণে ছোট মাছের চালান কমে গেছে। প্রথমত ছোট মাছের উৎপাদন কমে যাওয়া দ্বিতীয়ত বেড়ে গেছে স্থানীয় চাহিদা।

এ বিষয়ে পত্নীতলা উপজেলা মৎস কর্মকর্তা মো: আবু সাঈদ বলেন, প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট উভয় কারণেই দেশি জাতীয় অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়েছে। বিলুপ্তের পথে রয়েছে বহু প্রজাতির মাছ। প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে জলাভূমির সঙ্গে বিশেষ করে বিল ও নদীর গভীরতা কমে যাওয়া, বিল ও নদীতে বছরের অধিকাংশ সময় পানি না থাকা এবং প্রজনন মৌসুমে পানি প্রবাহ কমে যাওয়া। মনুস্যসৃষ্ট কারণগুরোর মধ্যে রয়েছে জমিতে রাসায়নিক সার ও অপরিকল্পিত মৎস আহরণ, প্রজনন মৌসুমে প্রজনন সক্ষম মাছ ও পোনা ধরা, কারেন্ট জালের ব্যবহার, চায়না জালের ব্যবহার, মাছের আবাসস্থল ধ্বংস করা এবং ক্ষতিকর মৎস আহরণ সরঞ্জামের ব্যবহার।

পড়তে পারেন: মাছ চাষে বিঘায় খরচ বেড়েছে ৪০ হাজার

তিনি আরো বলেন, আমরা বিভিন্ন যুগোপযোগী পদ্ধতির মাধ্যমে দেশীয় মিঠা পানিতে মাছের যত্নের ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। দেশীয় মাছ আমাদের দেশের সম্পদ তা রক্ষা করতে আমরা বিভিন্ন সময়ে জনসচেতনতা মূলক বিভিন্ন ধরণের কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকি।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা চেষ্টা করছি এ আট প্রজাতিসহ আরও কয়েক প্রজাতির মাছ যেন আগামী বছরের মধ্যে পাতে ফেরাতে পারি। তবে সবটা আমাদের হাতে থাকে না। কারণ এটা জোর করে হয় না। আমাদের চারটি কেন্দ্র চেষ্টা করছে। ফলে কতো প্রজাতির মাছ পাতে ফেরাতে পারবো সেটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন।

পাবদা, গুলশা টেংরা, গুজি আইড়, চিতল, ফলি, মহাশোল, বৈরালি, বালাচাটা, গুতুম, কুচিয়া, ভাগনা, খলিশা, গজার, রানি, বাতাসি, পিয়ালিসহ ৩১ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় মাছ চাষের পদ্ধতি উদ্ভাবন করে মৎস্যচাষিদের হাতে তুলে দিয়েছেন বিএফআরআই গবেষকরা।

উদ্ভাবিত এসব মাছে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও আয়োডিনের মতো প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ। এসব উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করে। পাশাপাশি রক্তশূন্যতা, গলগণ্ড, অন্ধত্ব প্রভৃতি রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলাশয় সংকোচন, অতি আহরণসহ নানা কারণে মাছের প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্র বিনষ্ট হওয়ায় প্রাকৃতিক জলাশয়ে ছোট মাছের প্রাপ্যতা ক্রমে কমছে।

পড়তে পারেন: মাছ চাষে কোটিপতি ফরহাদ, চলতি বছরে ৭০ লাখ!

বিএফআরআই সৈয়দপুর উপকেন্দ্র প্রধান ড. খোন্দকার রশীদুল হাসান বলেন, সৈয়দপুর উপকেন্দ্রে আমরা মূলত তিস্তা অববাহিকার যে দেশি ছোট মাছ আছে সেগুলো নিয়ে কাজ করছি। আমাদের এখানেও একটি লাইভ জিন ব্যাংক করেছি। এরই মধ্যে সক্ষম হয়েছি ৪০টি প্রজাতি সংগ্রহ করতে, যেগুলো বিলুপ্তপ্রায়। তবে কমনগুলো এখানকার জিন ব্যাংকে রাখিনি, এখানে যেগুলো আছে সেগুলো ময়মনসিংহে নেই বা কম আছে। আমরা প্রজাতি রক্ষার চেষ্টা করছি।

‘যেমন বৈরালি, বৈরালির পাঁচটি প্রজাতি, হিরালু, বোল, জারুয়া, লইট্যা টেংরা, বটিয়াসহ বেশ কিছু মাছ। মন্ত্রণালয় ও ডিজি মহোদয় চান এটা ময়মনসিংহের একটি রেপ্লিকা হবে। কোনো কারণে এক জায়গায় সমস্যা হলে আরেক জায়গায় যেন পাওয়া যায়।’

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ