মেহেদী হাসান, নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী: রাজশাহীতে উৎপাদিত প্রায় ৮৫ শতাংশ মাছ কার্প জাতীয়। সারাদেশে সুনাম কুড়িয়ে কার্প জাতীয় মাছ (রুই, কাতল, মৃগেল ইত্যাদি) উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে এই জেলা। জেলায় মৎস্য উৎপাদন ও বিপণন-বিক্রির সঙ্গে জড়িত প্রায় ৯ লাখ মানুষ। এ বিপুল কর্মসংস্থানের মূলেও রয়েছে এখানকার মাছচাষিরা। কিন্তু বর্তমানে তারা বলছেন, কোনমতে জীবন ধরে বেঁচে আছেন। তেমন লাভ হচ্ছে না মাছ চাষে। আগের তুলনায় মাছের প্রতি বিঘায় খরচ বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা।

চাষিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মাছচাষে বাড়তি দামে মাছের ফিড, খাজনা, ওষুধ ও পুকুরের লিজ নেওয়াসহ প্রতিবিঘা মাছ চাষে প্রায় খরচ বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ হাজার। আগের তুলনায় লাভের অংশ হারিয়ে এখন ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হিমসিম খাচ্ছেন তারা। বর্তমানে মাছচাষ ছেড়ে পেশা বদলের মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অনেকে।

পড়তে পারেন: অল্প পুঁজিতে লাভজনক গ্রাসকার্প মাছ চাষ পদ্ধতি

রাজশাহী জেলার সবচেয়ে বেশি মাছচাষ হয় পবা উপজেলার পারিলা এলাকায়। একেকটি পুকুর শতবিঘার উপরে। এখানকার ৯৫ শতাংশ মানুষ মাছচাষ কিংবা বিপণনের সাথে জড়িত।

পারিলা বাজারের এলাকার মাছচাষি তাশামুর রহমান। তারা সাথে আলাপ হয় মাছচাষের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে। তিনি এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, বর্তমানে আইসিউতে আছে মাছচাষিরা। সবকিছুর দাম এমনভাবে বেড়ে যাবে আগে কল্পনাও করতে পারিনি। মাছের ২৫ কেজি ফিডে বেড়েছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। আগে যে বস্তা ৭০০ টাকায় পাওয়া যেতো তা ১১০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। পুকুরের লিজ গতবছরেও ছিল ৫০ হাজার টাকা বিঘা কিন্তু এবার ৭০ থেকে ৭২ হাজার টাকায় দাঁিড়য়েছে। মাছের দাম কিন্তু বাড়েনি।

ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, সবকিছুর দাম বেড়েছে; মাছের দাম বাড়েনি। ২ কেজি ওজনের রুই আমরা পুকুর থেকে বিক্রি করছি ২৫০ টাকা কেজি। ৪ থেকে ৫ কেজির কাতল বিক্রি করছি ২৮০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা কেজি হিসেবে। ১ কেজি ওজনের মিড়কা বিক্রি হচ্ছে মাত্র দেড়শ টাকা দরে। এই দাম দিয়ে মাছ বিক্রি করে জুতোজোড়া! কোন লাভ হয়না। যারা মাছচাষ করেন তারা এই কষ্টটা বুঝতে পারছেন কিসের মধ্যে চাষিরা রয়েছেন।

পড়তে পারেন: মাছ চাষে কোটিপতি ফরহাদ, চলতি বছরে ৭০ লাখ!

একই এলাকার মাছচাষি গফুর মোল্লা। বর্তমানে ১০০ বিঘিা জমিতে মাছ রয়েছে তাঁর। জানতে চাইলে এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, আগে মাছের খৈল কিনতাম ২৫০০ থেকে ২৬০০ টাকা বস্তা। ৭৪ কেজির খৈলে বেড়েছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। এখন ৩৩০০ টাকা বস্তা কিনতে হচ্ছে।

বিস্তারিত জানতে চাইলে এই চাষি বলেন, এক বিঘার পুকুরে মাছচাষ করতে খাবারে খরচ হয় কমপক্ষে ৮০ হাজার টাকা। লিজ নিতে দিতে হয় ৬০ হাজার। মাছের দাম ৪০ হাজার। ওষুধ ও অন্যান্য খরচ কম করে হলেও ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার। ২ লাখের উপরে খরচ পড়ে যায় বিঘাতে। অন্যদিকে বিঘাতে মাছ বিক্রি হয় ২ লাখ ২০ হাজার থেকে আড়াই লাখ টাকার মতো। কপাল ভালো হলে ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা লাভ হয়। কিন্তু এখন ৩০ হাজার টাকা বেশি খরচ হওয়ার কারণে লাভের ভাগ খরচের দিকে চলে গেছে। গাড়িভাড়া, লেবার খরচ, উৎপাদন খরচ সবমিলিয়ে উচ্চমাত্রায় পৌঁছেছে। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হয় তাই এভাবে চলা।

পড়তে পারেন: কসাই থেকে মাছ চাষে কোটিপতি আইনাল

কথা হয় মাছচাষি শফিকুল ইসলামের সাথে। তিনি এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, আমরা মাছচাষ করে কোটিপতি হতে পারিনি। বছরে যা লাভ আসে তাতে ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে পারি। অন্যকোন পেশাতে যেতে পারিনা তাই এই ব্যবসা আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার খরচ আর সামান্য কিছু পারিবারিক ফসলী জমির আয় দিয়ে কোনমতে টিকে আছে চাষিরা। তবে, মাছের দাম বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। চাল-ডাল, ময়দা তেল সবকিছুর দাম বেড়েছে সে তুলনায় মাছের দাম বাড়েনি।

পারিলা গ্রামের বাসিন্দা সোহরাব হোসেন। প্রায় দুই যুগ ধরে মাছ চাষ করছেন। ছোট বড় মিলিয়ে তাঁর পুকুর সংখ্যা ২১ টি। যার আয়তন ২৫০ বিঘা ছাড়িয়ে। প্রতিবছর এসব পুকুর থেকে আয় হয় ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা। কিন্তু এবার লাভ করতে পারছেন না তিনি।

এই মাছচাষি বলেন, গত বছরে ৩-৫ কেজি ওজনের রুই বিক্রি করেছি ৩২০ থেকে ৩৩০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু এবার কেজিতে নাই হয়ে গেছে ৪০-৫০ টাকা। বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকা, ২৯০ টাকায়। ৫-৬ কেজির গ্রাস কার্প গতবছর এ সময়ে বিক্রি করেছি ২৭০ থেকে ২৮০ টাকা কেজি। এবার ২১০-২২০ টাকা কেজি কিনতে গড়িমসি করছেন পাইকারররা। গতবছর ৬-৭ কেজি ওজনের কাতল বিক্রি হয়েছে সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি, এবার ৩০০-৩২০ টাকা কেজি। ১০ কেজি ওজনের কাতল গতবারে বিক্রি করেছি ৫০০ টাকা এবার সেই কাতল ৪০০-৩৯০ টাকা কেজি।

পড়তে পারেন: মাছ চাষে কোটিপতি রাজশাহীর সোহরাব

একই কথা বলেন পারিলা এলাকার মাছচাষি আইনাল হকসহ অনেকে। আইনাল হক এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, জাল-দড়ি, বিষ, কামলার দাম সবকিছুই বেশি কিন্তু মাছের দাম কম। এভাবে চলতে থাকলে মোটা অংকের লোকসান হবে। আমাদের দেখার কেউ নাই, খাদ্যের দাম বাড়ছে, ঔষুধের দাম বাড়ছে কিন্তু মাছের দাম কেন বাড়ছে না বোধগম্য নয়।

রাজশাহী জেলা মৎস্য সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে মাছ উৎপাদন হয় ৮২ হাজার ৫৪৫ মেট্রিন টন। বার্ষিক মাছের চাহিদা ৫২ হাজার ৬৩ মেট্রিক টন। ফলে উদ্বৃত্ত থাকে ২৮ হাজার ৭৮ মেট্রিক টন। ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২০ সালে মাছের উদ্বৃত্ত প্রায় আড়াই গুণ। সেইসাথে মোট জলাশয়ের সংখ্যা তিন ৪৮ হাজার ৪২৭টি থেকে বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজার ৫১৫টিতে। বাড়তি উৎপাদিত রুই, কাতলা, ম্রিগেল, গ্রাসকার্প, ব্লাডকার্প, সিলভারসহ বিভিন্ন কার্প জাতীয় মাছ কৌশলে ট্রাকে করে কয়েকবার পানি বদলিয়ে পৌঁছে যায় ঢাকার বিভিন্ন বাজারে।

পড়তে পারেন: মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় স্থানে বাংলাদেশ

মাছচাষ নিয়ে সমস্যায় জর্জরিত চাষিদের নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে জেলা মৎস্য অধিদপ্তর। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অলক কুমার সাহা এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, মাছের উৎপাদন খরচ বেড়েছ। সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় এ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন তারা। তবে কিভাবে উৎপাদন খরচ কমানো যায় খাদ্যের সঠিক ব্যবহার করা যায় সে বিষয়ে চাষিদের নিয়মিত পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ