মেহেদী হাসান, নিজস্ব প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: রাজশাহী নগর থেকে পূর্ব-উত্তরের সবুজ-শ্যামল গ্রাম পারিলা। গ্রামের আনাচেকানাচে যেদিকে চোখ যায় পুকুর আর পুকুর। এখানে ব্যক্তিপর্যায়ে চলছে মাছের চাষ। প্রায় দুই যুগ আগে শুরু হওয়া মাছ চাষ এখন বিপ্লবে রুপ নিয়েছে।

এই গ্রামের বদৌলতে জেলায় বছরে প্রায় ১৭শ কোটি টাকার মাছ উৎপাদন হয়। এখানকার উৎপাদিত পোনা ছড়িয়ে যায় জেলার সর্বত্র। এসব মাছ উৎপাদন ও বিপণন-বিক্রির সঙ্গে জড়িত হয়ে কমছে বেকার সংখ্যা। কর্মসংস্থান ও আর্থিক লাভের আশায় বাড়ছে মাছ চাষ। ফলে সারাদেশে কার্পজাতীয় মাছ উৎপাদনে শীর্ষস্থান দখল করেছে।

রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলা গ্রামের বাসিন্দা সোহরাব হোসেন (৫৫)। বাবা নূর মোহাম্মদ মারা যাওয়ার পর ছয় ভাইয়ের মধ্যে হাওয়া বদলের ধাক্কা লাগে। প্রকৃতির নিয়মে একে একে আলাদ হতে থাকে তারা। বাবার পঞ্চম পুত্র হওয়ায় বিপাকে পড়েন সোহরাব। ছোটভাই গোলাম মোস্তফাকে সাথে নিয়ে শুরু করেন কৃষি কাজ। একসময় দেখলেন নিজেদের পুকুরে মাছের পোনা চাষ করে লাভবান হচ্ছেন অন্য মানুষ। স্থির করলেন মাছ চাষ শুরু করবেন।

সালটা ১৯৯৪। নিজস্ব ৩ বিঘা পুকুরে ছাড়লেন মাছের পোনা। এক বছরের মধ্যে ১০ বিঘা জমি লিজ নিয়ে ছাড়লেন সেই পোনা। বছর শেষে ৮০ হাজার টাকা খরচে পকেটে উঠলো দেড় লাখ টাকা! এখন তিনি ২৮০ বিঘা জমিতে চাষ করছেন কার্প জাতীয় মাছ। শূণ্য হাত থেকে বর্তমানে বছরে গুনছেন কোটি টাকা। জেলার সেরা মৎস্য চাষি হিসেবে পেয়েছেন পুরস্কার।

প্রায় ২৭ বছর ধরে মাছ চাষ করছেন সোহরাব হোসেন। ছোট বড় মিলিয়ে তাঁর পুকুর সংখ্যা ২৫ টি। যার আয়তন ২৮০ বিঘা ছাড়িয়ে। প্রতিবছর এসব পুকুর থেকে আয় হয় ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা। এসব পুকুরে উৎপাদিত মাছ বিক্রি করেই তিনি এখন কোটিপতি। চাষ করেন রুই, কাতলা, ম্রিগেল, গ্রাসকার্প, ব্লাডকার্প, সিলভারসহ বিভিন্ন কার্প জাতীয় মাছ। পুকুরের এসব তাজা মাছ কৌশলে ট্রাকে করে কয়েকবার পানি বদলিয়ে পাঠান ঢাকার ফার্মগেট, কাওরান বাজারে।

মাছ চাষ সফলতার গল্প শোনালেন অভিজ্ঞ মাছ চাষি সোহরাব হোসেন। তিনি জানালেন মাছ চাষব্যস্থাপনায় যেসব কৌশল অবলম্বন করেন, আগেকার তুলনায় বর্তমান সময়ে মাছ চাষে ঝুঁকি, সমস্যার কথা। জানান, এই গ্রামের ৯৫ ভাগ মানুষ মাছ চাষে জড়িত। কেউ কেউ নিজের জমিতে, আবার কেউ অন্যের জমি চুক্তিতে ভাড়া নিয়ে মাছ চাষ করছেন। এসব মৎস্য চাষ প্রকল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রচুর বেকার লোকজনের। রাজশাহীর মোট মৎস্য উৎপাদনের বেশির ভাগ এখানেই উৎপাদিত।

দু-দশক আগের তুলনায় এখন মাছ চাষে পরিবর্তন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন মাছ চাষে খরচ প্রচুর বেড়ে গেছে। সার, খৈল, প্রো-বায়োটিকের দাম আকাশছোঁয়া। প্রতিবিঘা জমিতে মাছ চাষে প্রায় ২ লাখ টাকা খরচ পড়ছে। কোন সময় লাভ হয় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ, আবার লোকসানও যায়। ১ হাজার টাকার সারের বস্তা সময়ে ১৭০০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়। মাছের দামের ঠিক নাই। অথচ আগে কম খরচে মাছ চাষ করে বেশি লাভ হতো।

মাছ চাষে সমস্যার উল্লেখ করে এই অভিজ্ঞ মাছ চাষি বলেন, মাছের লেজ, পাখনা, পায়ুপথে পচন রোগ হয়; বাজারে ভালো অষুধ নাই। পোল্ট্রির অষুধ ব্যবহার করতে বলেন কোম্পানির লোকজন, অষুধ কাজে আসেনা। হটাৎ আবহাওয়ার পরিবর্তনে মাছ মরে ভেসে উঠে। আমাদের কিছু করার থাকে না। লোকসান খেয়ে পথে বসলেও সরকারি সহযোগিতা তো দুরের কথা, ঋণ পর্যন্ত মেলে না। অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে এই পেশা। প্রণোদনা ঋণ মৎস্য চাষিরা ২ ভাগও পায়নি। একশ বিঘা জমিতে মাছ চাষ করতে দুই কোটি টাকা খরচ হয়। ১০ লাখ টাকা ঋণ নিতে গেলে জমির দলির চায়। নিজের জমিতে তো আর মাছ চাষ করিনা, লিজ নেওয়া থাকে। মূলত আমরা দেশকে দিলেও দেশ আমাদের দিকে দেখে না।

মাছ চাষের কৌশল অবলম্বন হিসেবে আবহাওয়ার দিকে খেয়াল রেখে খাবার দেওয়া, পানির অক্সিজেনের দিকে লক্ষ্য রেখে মাছ মজুদ করা, নিয়মিত প্রো-বায়োটিকের ব্যবহার করা, জাল টেনে মাছের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। সার্বক্ষণিক মৎস্য কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ রাখা এবং বাড়িতে অক্সিজেন মজুদ রাখা। যাতে যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যায়। সম্ভব হলে পুকুরে অ্যারেটর যন্ত্র লাগনোর পরামর্শ দেন সোহরাব হোসেন।

জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহীতে উৎপাদিত মাছের কার্প জাতীয় মাছ প্রায় ৮৫ শতাংশ। এছাড়াও কার্পজাতীয় মাছ উৎপাদনে শীর্ষে থাকা রাজশাহী থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিদিন প্রায় ১৫০ ট্রাক মাছ রপ্তানি হয়ে থাকে। জেলায় ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে মোট ৫০ হাজার পুকুর রয়েছে। এখানে বছরে মাছ উৎপাদন হয় প্রায় ৮৪ হাজার টন। আর স্থানীয়ভাবে মাছের চাহিদা রয়েছে ৫২ হাজার টন। ফলে রাজশাহীতে চাহিদার বিপরীতে ৩২ হাজার টন বেশি মাছ চাষ হয়। এই মাছের অধিকাংশই পবা উপজেলার।

জানতে চাইলে পবা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো: মোজাম্মেল হক এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, আমি নতুন যোগদান করেছি। এখন মাঠেই আছি। বগুড়া থেকে মাছ চাষে অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য একটা টিম এসেছে। তাদের সাথেই আছি। চাষিদের পরামর্শ দেওয়া, পাশে থাকাই আমাদের কাজ।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অলক কুমার সাহা এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, পবা উপজেলা পারিলার মাছ চাষি সোহরাব হোসেন একজন পাইওনিয়ার। নিয়মিত যোগাযোগ করা হয়, পরামর্শ নিতে আসেন। উপজেলা কর্মকর্তার পাশাপাশি খোঁজখবর নেওয়া হয়। মাছ চাষকে উনারা অনেক দূর নিয়ে গেছেন।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ