পুকুরে মলা মাছ চাষ

মৎস্য ডেস্ক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: পুষ্টিতে যেমন সেরা ঠিক তেমনি পুকুরেও মলা চাষ অনেক বেশি লাভজনক। বছরে দুই থেকে তিনবার ডিম দেয়ায় এ মাছের উৎপাদনও অনেক বেশি হয়। জেনে নেয়া যাক পুকুরে মলা মাছ চাষ পদ্ধতি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য।

মলা মাছের প্রজনন: মলা মাছ প্রথম বছরেই প্রজননক্ষম হয়। সাধারণত এপ্রিল থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত এরা প্রজনন করে থাকে। বছরে কমপক্ষে ২-৩ বার ডিম দেয়। ডিম দেওয়ার ক্ষমতা: ১০০০-৮০০০টি। পুষ্টিমান: মলাতে প্রচুর ভিটামিন-এ, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও আয়রণ থাকে।

স্থান নির্বাচন পুকুরের বৈশিষ্ট্য: পুকুর রৌদ্র আলোকিত খোলামেলা জায়গায় হাওয়া উত্তম এবং পাড়ে ঝোপ-জঙ্গল থাকলে তা পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। পুকুর পাড়ে বড় গাছপালা থাকলে সেগুলোর ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে এবং দিনে কমপক্ষে ৮ ঘন্টা রৌদ্রালোক পড়া নিশ্চিত করতে হবে। ব্যবস্থাপনা সুবিধার জন্য পুকুর আয়তকার হতে হবে।

পুকুরের আয়তন ১৫-২০ শতক থাকা আবশ্যক। পুকুরের গড় গভীরতা ৩.৫-৪.৫ ফুট হলে ভাল হয়, যেখানে বৎসরে ন্যূনতম ৫-৬ মাস পানি থাকে। পুকুরে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা থাকা, এতে পরিপক্ক মাছের প্রজনন ঘটানো সহজতর হয়। পুকুরের তলদেশ সমতল ও পচাঁ কাদা মুক্ত হতে হবে। বন্যামুক্ত ও বসতবাড়ীর আশে পাশে।

পুকুর প্রস্তুতি: পুকুরের পাড় মেরামত করতে হবে। প্রথমে পুকুরকে সেচের মাধ্যমে শুকিয়ে ফেলা প্রয়োজন। পুকুর শুকানো সম্ভব না হলে প্রতি শতাংশে প্রতি ফুট গভীরতার জন্য ১৮-২৫ গ্রাম রোটেনন পাউডার দিয়ে সব ধরনের মাছ অপসারণ করা যায়। পুকুরের তলায় কাদা হওয়ার বেশি সম্ভাবনা থাকলে হালকা করে কিছু বালি (দালান-কোঠা নির্মাণের জন্য যে বালু ব্যবহৃত হয়) ছিটিয়ে দেয়া যেতে পারে। এর ফলে পুকুরের তলায় গ্যাস হবে না, পানি পরিষ্কার এবং পরিবেশ ভাল থাকবে।

রোটেনন প্রয়োগের ২ থেকে ৩ দিন পর শতাংশ প্রতি ১ কেজি হারে পাথুরে চুন প্রয়োগ করতে হবে। তবে চুন ছাড়াও জিওলাইট (প্রতি শতকে ১ কেজি) পুকুর প্রস্তুতির সময় প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি তথা প্রাকৃতিক খাদ্যে বৃদ্ধির জন্য সার প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। পুকুর প্রস্তুতির শেষ ধাপে সার প্রয়োগ করা হয়। চুন প্রয়োগের ৪-৫ দিন পর শতকে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৫০ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ করা হয়।

মলা মাছ পুকুরে মজুদ: প্রাকৃতিক উৎস যেমন- খাল, বিল বা বড় পুকুর হতে মলার ব্রুড সংগ্রহ করে চাষের পুকুরে মজুদ করতে হবে। প্রতি শতকে ৪০০টি মলা মাছ মজুদ করতে হবে। একবার মাছ স্টক হলেই হল। প্রজননের জন্য আর কিছুর প্রয়োজন নেই।

মাসখানেক পর থেকেই মলা মাছ ডিম দিতে শুরু করবে। প্রথম দুইমাস কোন মাছ ধরা যাবে না। শুধু বংশ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে। মলা মাছের প্রচুর পরিমাণে প্রজননের জন্য অমাবস্যায় বা পূর্ণিমার রাতে পুকুরে পানি দেয়ার ব্যবস্থা করলে পর্যাপ্ত পরিমাণে বাচ্চা পাওয়া যাবে।

খাদ্য ব্যবস্থাপনা: খাবার হিসেবে শুধুমাত্র অটোকুঁড়া পুকুরে ভাসিয়ে দিতে হবে। মাছের দেহের মোট ওজনের ৫% হারে অটোকুঁড়া পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। অন্য খাবার ব্যবহার করলে পুকুরের পানির রঙ সবুজ হয়ে যেতে পারে। পানি বেশি সবুজ হলে মলা মাছের ডিমপাড়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে বা বাচ্চা দেয়ার হার কমে যেতে পারে। কারণ, মলা মাছ স্বচ্ছ পানিতে বাস করতে ও প্রজনন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। অটোকুঁড়া পানিতে ভেসে থাকে বিধায় সমস্ত খাবার।

অন্যান্য ব্যবস্থাপনা: পুকুরের পানি ভালো রাখার জন্য ১৫ দিন পর পর হররা টেনে দিতে হবে। চাষকালীন সময়ে শামুকের আধিক্য পরিলক্ষিত হলে শতাংশ প্রতি ১০০-২০০ গ্রাম ইউরিয়া প্রয়োগে শামুকের আধিক্য কমবে। অ্যামোনিয়া গ্যাস দূর করার জন্য অ্যামোনিল (প্রতি একরে ২০০ মি.লি.) ব্যবহার করতে পারেন।

১৫ দিনে একবার নমুনা সংগ্রহ করে গড় বৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে মোট খাদ্যের পরিমাণ ঠিক করে নিতে হবে। পুকুরের পরিবেশ ভালো রাখতে প্রতি মাসে একবার পুকুরে জিওলাইট অথবা চুন দিতে হবে (শতকে ১৫০ গ্রাম)। মাছ নিয়মিত খাবার খায় কিনা সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

এক পুকুরের জাল অন্য পুকুরে ব্যবহারের আগে ভাল পানির সাথে জিবাণু নাশক পটাশ মিশিয়ে পরিষ্কার করে নিন। অনেক সময় বক, মাছরাঙা, জলজ পাখি থেকে রোগ জীবাণুর সৃষ্টি হয়। তাই পুকুরের চারদিকে রঙিন ফিতা টানিয়ে দিন। একটানা মেঘলা আবহাওয়ায় কিংবা অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে অথবা একেবারে বন্ধ করে দিতে হবে।

আরও পড়ুন: সিলভার কার্প মাছের রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার

আহরণ বিক্রয়: দুইমাস পর থেকে প্রতি ১৫ দিন অন্তর মাছ আহরণ করা যাবে। মাছ আহরণের সময় এমন জাল ব্যবহার করতে হবে যাতে শুধু বড় মলা মাছগুলো জালে উঠে আসে। আর ছোট মাছগুলো জালের ফাঁক দিয়ে পুকুরে চলে যায়। এভাবে প্রতি ১৫ দিন পর পর মাছ ধরা যাবে। ছয় মাস পর পুকুরের পানি শুকিয়ে সমস্ত মাছ ধরা যেতে পারে।

মলা মাছের বাজারজাত: মলা মাছ একটি নরম প্রকৃতির মাছ। পুকুর থেকে মাছ আহরণের পর মলা মাছকে বেশিক্ষণ স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখা যায় না। ২ থেকে ৩ ঘন্টা পর থেকেই মলা মাছ পচে যাওয়া শুরু করে। মলা মাছকে পুকুর থেকে ধরেই বরফ দিতে হবে। এভাবে মাছ সংরক্ষণ করলে ১২-১৮ ঘন্টা পর্যন্ত টাটকা অবস্থায় রাখা যায়। এ সময়ের মধ্যে দেশের যে কোন প্রান্তে বাজারজাত করা সম্ভব।