নিজস্ব প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: পোল্ট্রি ও মাছের ফিডে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এতে মাছ ও মুরগির মাংস উৎপাদন খরচ ৮-১০ টাকা বাড়বে। তবে, মাছ ও পোল্ট্রি ফিড খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন বাধ্যতামূলক পাটের প্যাকেজিং বার্ষিক প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার অপচয়ের কারণ হতে পারে। তাছাড়া সরকারের এই সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী হিসেবে দেখছেন তারা।

২০১০ সালে পাশ করা “বাধ্যতামূলক পাট প্যাকেজিং আইন”-এর অধীনে পাটের বস্তায় খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা বাধ্যতামূলক। এই আইন বাস্তবায়ন করতে বেশ কয়েক বছর ধরেই কাজ করছে সরকার। পোল্ট্রি ও ফিস ফিডের মিল মালিক এবং সংশ্লিষ্টদের পক্ষে-বিপক্ষে মতামতের কারণে তা হয়ে উঠেনি। প্লাস্টিকের বস্তার বদলে পাটের বস্তা ব্যবহারে বড় ধরণের ক্ষতি হতে পারে। আর্থিক ছাড়াও বায়োলজিক্যাল সমস্যা সৃষ্টি হয়ে খামারের মাছ ও মুরগি মারা যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এসব সমস্যা লিখিত আকারে দিয়েও দুই বছরে উত্তর পাননি পোল্ট্রি খাত সংশ্লিষ্টরা।

পড়তে পারেন:ডিম-মুরগির দাম নির্ধারণ করে কারা, কেন ধরা খায় খামারিরা?

কথা হয় বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মোহসিনের সাথে। তিনি এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, পোল্ট্রি ফিডের বস্তায় কোন ধরণের বাতাস প্রবেশ করলে খাদ্য নষ্ট হয়ে যাবে। খাদ্যের গুণগত মান নষ্ট হয়ে বিষক্রিয়া হবে। যদিও পাটের বস্তায় নেওয়া হয় তাহলে প্লাস্টিকের লেমোনেটিং করতে হবে। তাহলে তো প্লাস্টিক থাকছেই। পাটের বস্তায় পোল্ট্রি খাদ্য এটি  একটি অবৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা।

তিনি আরো বলেন, এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে ( পাট অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, কৃষি অধিদপ্তরসহ) লিখিত আকারে জানানো হয়েছে। দুই বছর হয়ে গেছে কোন উত্তর পাইনি। পাটের বস্তায় পোল্ট্রি খাদ্য উৎপাদন খরচ বাড়াবে। এমনিতেই করোনায় পোল্ট্রি সেক্টরের অবস্থা নাজুক। সেখানে এমন সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। অতিসত্তর এই সিদ্ধান্ত থেকে সরকারের সরে আসা উচিত।

পড়তে পারেন: সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পোল্ট্রি শিল্প

২০১৩ সালে এই আইনের অধীনে বিধিগুলো প্রকাশ করা হয়েছিল। আইনে মাছ ও মুরগির খাবারসহ অন্যান্য বেশ কয়েকটি পণ্যের জন্য পাটের প্যাকেজিং বাধ্যতামূলক করা হয়। এই নিয়মগুলো কার্যকর করার জন্য, ভ্রাম্যমাণ আদালত বিভিন্ন সময়ে ফিড মিল পরিদর্শন করে জরিমানাও করে আসছে।

বাংলাদেশ প্রান্তিক পোল্ট্রি শিল্প সংগঠনের সভাপতি ইসমাইল মল্লিক এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, আমরা পোল্ট্রি খাতকে রক্ষা করার জন্য দীর্ঘদিন আন্দোলন করে আসছি। গত দুই বছরে প্রতি ফিডের বস্তায় বেড়েছে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। আবার নতুর করে দফায় দফায় দাম বাড়ানো হচ্ছে। ৫ বছর আগেও ৫ টাকা পিস ডিম; এখনও ৫ টাকা দরে বিক্রি করতে হয়। সরকারের এদিকে একটু যদি সঠিক তদারকি করতেন তাহলে লাখ লাখ খামারি রক্ষা পেতো। এখন আবার পাটের বস্তায় ফিডের সিদ্ধান্ত উৎপাদন খরচ বাড়ানো পাঁয়তারা চলছে। যদি এমনটি হয় তাহলে অনেক খামার বন্ধ হয়ে যাবে।

পড়তে পারেন: স্থিতিশীল ব্রয়লার, বেড়েছে সোনালী মুরগির দাম

এদিকে কাজী ফার্মস গ্রুপের পুষ্টি ও মান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে ব্যবহৃত পিপি বোনা বস্তার প্রতিটির দাম ৩৬ টাকা। পাটের বস্তা ব্যবহার করলে প্রতিটি বস্তার দাম পড়বে ১১৮ টাকা। এতে প্রতিটি বস্তার দাম তিনগুণ বেড়ে যাবে। এতে প্রান্তিক কৃষকদের ওপরও প্রভাব ফেলবে। তাদের লোকসান হবে। এর ফলে ভোক্তাদেরও বেশি দামে মুরগি, ডিম ও মাছ কিনতে হবে। মুরগির উৎপাদন খরচ প্রতি কেজি ৫-১০ টাকা বেড়ে যাবে,।”

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোল্ট্রি সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. ইলিয়াস হোসেন বলেন, “ভুট্টা, সয়াবিন, লবণ, তেল এবং অন্যান্য উপাদান দিয়ে পোল্ট্রি ফিড তৈরি করা হয়। এটি বাতাস থেকে আর্দ্রতা শোষণ করতে পারে, যার ফলে ছত্রাক বৃদ্ধি পায় এবং ফিডে মাইকোটক্সিন নামক বিষ তৈরি করে। মুরগি বা মাছ যদি পাটের বস্তায় রাখা খাবার খায় তাহলে তাদের বৃদ্ধির হার কমে যাবে। অনেক ক্ষেত্রে, প্রাণীটি মারাও যেতে পারে।”

পড়তে পারেন: দেশ সেরা খামারি হলেন রাজশাহীর ইয়াসির আরাফাত

পোল্ট্রি বিশেষজ্ঞ আখতারুজ্জামান বলেন, “মাছ ও পোল্ট্রি ফিডে আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি অবশ্যই ১০% থেকে ১২%-এর মধ্যে বজায় রাখতে হবে। সাধারণত দোকান ও খামারগুলোতে ফিড ৬০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু, একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, পাটের বস্তায় সংরক্ষণ করলে মাত্র ১০ দিন পরই মাছ বা পোল্ট্রি ফিড খারাপ হয়ে যায়। ফিড প্রস্ততকারকদের পক্ষে সাধারণ পাটের বস্তা ব্যবহার করা অসম্ভব।

পোল্ট্রি দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং ক্রমবর্ধমান শিল্প। এই শিল্পে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে, যা জিডিপির প্রায় ১.৪৪%। অন্যদিকে, পাট শিল্প জিডিপির প্রায় ০.২৬%। ফলে পোল্ট্রি শিল্প বিশেষজ্ঞদের যুক্তি, পাট শিল্পে লাভবান হওয়ার জন্য পোল্ট্রি ও মাছ শিল্পের ক্ষতি করার কোনো মানে হয় না। এই নীতি পোল্ট্রি শিল্পের জন্য হুমকিস্বরূপ।

কাজী ফার্মের মহাব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম আরও বলেন, “প্রতিটি পাটের বস্তার দাম একটি বোনা পিপি বস্তার চেয়ে ৮২ টাকা বেশি। ফিড শিল্পে পাটের বস্তা ব্যবহার করলে প্রতি বছর ৩০ কোটি পাটের বস্তার প্রয়োজন হবে, যার জন্য প্রতি বছর অতিরিক্ত ২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা খরচ হবে। পাটের বস্তা ব্যবহার করা হলে বাড়তি খরচ কৃষকদের হাতে চলে যাবে। তাই ভোক্তাদের শেষ পর্যন্ত মুরগি, ডিম ও মাছ বেশি দামে কিনতে হবে।”

ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (এফআইএবি) সাধারণ সম্পাদক আহসানুজ্জামান বলেন, “প্রতি বছর ৩০ কোটি বস্তার প্রয়োজন হয়। এই মুহূর্তে বেসরকারি পাটকলগুলোর এ পরিমাণ পাটের বস্তা উৎপাদনের কোনো সুযোগ নেই।”

পোল্ট্রি শিল্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পোল্ট্রি শিল্পের খরচ না বাড়িয়ে প্যাকেজিং সমস্যার সমাধান করা উচিত। তারা কম খরচে বায়ো-ডিগ্রেডেবল প্যাকেজিংয়ের জন্য গবেষণার পরামর্শ দেন। নতুন এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা জানান, পোল্ট্রি এবং ফিশ ফিডের জন্য পাটের প্যাকেজিং বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত নয়।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ