পোল্ট্রি ডেস্ক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: পোল্ট্রির বিভিন্ন রোগের কারণ ও তার প্রতিকার এবং প্রতিরোধের ব্যাপারে অভিজ্ঞতা না থাকলে লাভবান হওয়া যায় না।গুনতে হয় লোকসান। পোল্ট্রির বিভিন্ন রোগের কারণ ও তার প্রতিকার নিয়ে লিখেছেন কৃষিবিদ ডা. এম এ সবুর, জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।

বাংলাদেশের পুষ্টির অবস্থা আগের তুলনায় অনেক ভালো। অনেক ফ্যাক্টর এর পেছনে কাজ করছে। তবে আমিষের জোগানে পোলট্রি শিল্পকে অবশ্যই স্বীকৃতি দিতে হবে। পোলট্রি শিল্প এভাবে বিকাশ না হলে আমাদের পারিবারিক পুষ্টিতে আমিষের অবস্থান অনেক নিচে থাকত। দেশে পরিকল্পিতভাবে যেমন পোলট্রি শিল্প গড়ে উঠেছে আবার অপরিকল্পিতভাবেই অনেক পোলট্রি শিল্প গড়ে উঠেছে। সবাই কিন্তু সমানভাবে লাভ করতে পারে না।

বিশেষ কিছু কারণ তো আছেই এর পেছনে। পোলট্রি শিল্প বিকাশে জীব নিরাপত্তা বিশেষ ভূমিকা পালন করে সব সময়। বাংলাদেশ বাণিজ্যিক পোলট্রি বেশ বিকশিত হয়েছে। আর বিকাশমান এ ট্রেন্ডের কারণে পোলট্রি শিল্প অনেক এগিয়ে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশের মানুষ আমিষ গ্রহণে আগের তুলনায় অনেক বেশি পুষ্টি পাচ্ছে। পোলট্রি পালনে মূল সমস্যা হচ্ছে খামার ব্যবস্থাপনা ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ রোগ প্রতিরোধ করা। যদি খামার ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা অর্জন করা যায় তবে পোলট্রি পালন লাভজনক হয়। খামার ব্যবস্থাপনার মূল বিচার্য বিষয় হচ্ছে খামারে জীব নিরাপত্তা জোরদার করা। জীব নিরাপত্তার কিছু প্রাথমিক বিচার্য হচ্ছে-

১. জীব নিরাপত্তা সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করা বা থাকা;
২. জীব নিরাপত্তা বোঝার পর করণীয় নির্ধারণ।

মূলত এ দুইটি বিষয়কে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারলে পোলট্রি সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অনেক রোগব্যাধি প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

জীব নিরাপত্তা কী?

জীব নিরাপত্তা হচ্ছে এম কিছু ব্যবস্থার সমন্বয় যেখানে জীব বা প্রাণী স্বাস্থ্য ঝুঁকিমুক্ত থাকে। পোলট্রির ক্ষেত্রে জীব নিরাপত্তা তা হলে পোলট্রি ফার্মের কিছু ব্যবস্থাপনা যা পোলট্রি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যকরী ভূমিকা রাখে। পোলট্রি ফার্মে জীব নিরাপত্তার ক্ষেত্রে খামারের অবস্থান, ডিজাইন এবং এর স্বাস্থ্যগত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকে। পোলট্রি ফার্ম অবশ্যই শহর, বাজার এবং জনবসতিপূর্ণ এলাকার বাইরে স্থাপন করতে হয়। কারণ শহর, বাজার, জনবসতি থেকে হাজারো রকমের রোগব্যাধি ছড়ায় যা পোলট্রিবো সরাসরি আক্রান্ত করে। সুতরাং পোলট্রি ফার্ম অবশ্যই লোকালয় থেকে দূরে অবস্থিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

দ্বিতীয়ত খামারের ডিজাইন, সাধারণত পর্যাপ্ত আলো বাতাস চলাচল করতে পারে এ বিষয়টি মাথায় রেখে পোলট্রি খামারের ডিজাইন করতে হয়। আমরা এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ দিকে সম্মুখভাগ বিচার করে থাকি। যদি দক্ষিণে খামারের সম্মুখভাগ নির্বাচন করা না যায় তবে পূর্ব পশ্চিম মুখো ঘরের ডিজাইন চিন্তা করা যেতে পারে। দক্ষিণ দিকে দৈর্ঘ্য এবং পশ্চিম দিকে প্রস্থ বিবেচনায় এনে পোলট্রি ফার্মের ডিজাইন করলে পর্যাপ্ত আলো বাতাসের নিশ্চয়তা থাকে। আলো বাতাস রোগ নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত ভূমিকা রাখে। পোলট্রি খামার সবসময়ই আবর্জনা মুক্ত, পরিষ্কার থাকতে হয়। যদি এরকমভাবে খামারের স্থান ও ডিজাইন করা যায় তবে অবশ্যই খামারে রোগব্যাধির প্রকোপ কম হবে। এ হচ্ছে জীব নিরাপত্তার প্রথম বিষয়।

২. জীব নিরাপত্তা:

জীব নিরাপত্তা মূলত খামারের সার্বিক ব্যবস্থাপনাকে বোঝায়। এখানে খামারে প্রবেশদ্বার থেকে খামারের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট থাকে। খামারে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া খামারে প্রবেশ ঝুঁকিমুক্ত করার জন্য প্রবেশের আগে জীবাণুনাশক ফুটবাথ থাকতে হয়। সাধারণত পটাশের পানি অথবা আইওসান জাতীয় জীবাণুনাশক খামারের গেটে ফুটবাথ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

খামারে পোলট্রির রোগব্যাধি নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু রোগের প্রতিশেধক টিকা নিয়মিত প্রদানের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে পোলট্রির রানীক্ষেত, গামবোরো এবং কলেরা রোগের টিকা দেয়া অত্যাবশ্যক। রানীক্ষেত ও গামবোরো রোগের টিকা সরকারি পর্যায়ে তৈরি করা হয়। এক্ষেত্রে বাচ্চা মুরগির রানীক্ষেত রোগের টিকা বাচ্চার বয়স ১ দিন থেকে ৫ দিনের মধ্যে চোখে ফোটা আকারে দিতে হয় এবং বাচ্চার বয়স ২১ দিন হলে দ্বিতীয় ডোজ টিকা চোখে দিতে হয়। এরপর বাচ্চার বয়স ৬ মাস হলে বয়স্ক মুরগির রানীক্ষেত রোগের টিকা (RDV) ১ সিসি করে মাংসপেশিতে প্রয়োগ করতে হয়। গামবোরো রোগের টিকা ১ ফোটা করে বাচ্চার বয়স ১-৭ দিনের মধ্যে চোখে দিতে হয়।

এছাড়া বেসরকারিভাবে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত কিছু টিকা আছে যাকে আমরা Combined Vaccine বলি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই Combined টিকা রানীক্ষেত ও গামবোরো অথবা রানীক্ষেত ও ইনফেকশাস ব্রনকাইটিসেট প্রতিরোধক্ষম সমন্বিত টিকা হিসেবে বাজারে পাওয়া যায়। আমদানিকৃত এসব টিকা সাধারণত বাচ্চার বয়স ১ থেকে ৭ দিনের মধ্যে ফোটা আকারে চোখে প্রয়োগ করতে হয়। এভাবে টিকা প্রদানের মাধ্যমে আমরা রানীক্ষেত গামবোরো এবং ইনফেকশাস ব্রনকাইটিস রোগ প্রতিরোধ করতে পারি। এছাড়া লেয়ার ফার্মের জন্য কলেরা রোগ প্রতিরোধ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কলেরা রোগ দমনের জন্য সরকারি পর্যায়ে উৎপাদিত ফাউল কলেরা টিকা স্থানীয় প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে সংগ্রহ করতে হয় এবং মুরগির বয়স ৭০-৭২ দিন হলে ২ সিসি টিকা রানের মাংসে প্রয়োগ করতে হয়।

এ হচ্ছে পোলট্রি ফার্মে অধিক গুরুত্বপূর্ণ সংক্রামক রোগ দমনের উপায়। এছাড়াও পোলট্রিতে সালমোনেলা, ককসিডিয়া, ই-কোলাই এসব অনেক সংক্রামক রোগ হয়ে থাকে। সঠিক জীব নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা এসব রোগ দম করতে পারি।

তা হলে জীব নিরাপত্তা বিষয়টি কী দাঁড়াল? খামারে প্রবেশ থেকে টিকা দান এবং পোলট্রি পালনে কিছু ব্যবস্থাপনা যেমন লিটার পদ্ধতিতে পোলট্রি পালন করলে ১০-১৫ দিন পরপর লিটার পাল্টে দেয়া। মাঝে মাঝে লিটারের আর্দ্রতা পরীক্ষা করা। যদি লিটার ভেজা মনে হয় তবে লিটার পরিবর্তন করে নতুন লিটার বিছিয়ে দিতে হবে। লিটার প্রসঙ্গে আরও কিছু তথ্য লিটার অবশ্যই কাঠের গুড়া, ধানের তুষ, শুকনো খড় এবং এর সাথে ১০ শতাংশ চুন মিশিয়ে লিটার প্রস্তুত করতে হয়। এছাড়াও মাঝে মাঝে খামারে জীবাণুনাশক স্প্রে করতে হয়। এসব করার মধ্য দিয়ে সালমোনেলা, ইকোলাই এবং ককসিডিন্ডসিস রোগ দমন করা সম্ভব।

জীব নিরাপত্তার আরও কিছু বিষয় আছে, যেমন খামারে ব্যবহৃত পানির পাম্প, খাবার পাত্র এসব নিয়মিত পরিষ্কার করতে হয়। খেয়াল রাখতে হবে পোলট্রির জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা জীব নিরাপত্তার আর একটি দিক। এছাড়া খামারের ভেতরে পোকামাকড়, ইঁদুর, চিকা, কুকুর, বেড়াল, শেয়াল এসব প্রাণী যেন প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে। এসব কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট সার্বিক বিষয়কে দক্ষভাবে ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে পারলে পোলট্রির অধিকাংশ রেখে দমন করা সম্ভব এবং পোলট্রি পালনকে অধিক লাভজনক করা সম্ভব। সুতরাং রোগ নিয়ন্ত্রণ, জীব নিরাপত্তা ও খামারের লাভ এ সবকিছু একটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এজন্যই পোলট্রি ব্যবসাকে লাভজনক করতে জীব নিরাপত্তা ও রোগ দমন ব্যবস্থা সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হয়।

তবে যাই করি না কেন আমরা যেন সুন্দর সুষ্ঠু একটা পরিকল্পনা করি। আর দক্ষ সার্ভিস প্রোভাইডারের সাথে পরামর্শ করে খামারের কার্যক্রম শুরু করি। তাছাড়া শিডিউল করে নিয়মিত এবং পরিমিতভাবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা বা বিশেষজ্ঞদের সাথে আলাপ পরামর্শ করে যাবতীয় কার্যক্রম বাস্তবায়ন করি। তবেই আমাদের খামারভিত্তিক কার্যক্রম কম খরচে বৈজ্ঞানিক প্রযুুক্তি অবলম্বনে লাভজনক হবে। আমরা নিজেরা সমৃদ্ধ হব দেশকে দেশের কৃষিকে সমৃদ্ধ করতে পারব।

পোল্ট্রির বিভিন্ন রোগের কারণ ও তার প্রতিকার জানা থাকলে সহযেই রোগের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। পোল্ট্রির বিভিন্ন রোগের কারণ ও তার প্রতিকার শিরোনামে সংবাদের তথ্য কৃষি তথ্য সার্ভিস থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।