নিজস্ব প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ। একদিকে মহামারি করোনা ভাইরাস অন্যদিকে পোল্ট্রি পণ্যের দামে খামারিদের উঠছে না উৎপাদন খরচ। দিশেহারা প্রান্তিক খামারিরা উভয় সঙ্কটে। আবার সহায়তা দেওয়ার নামে তাদেরই পকেট কাটছেন একটি সংঘবদ্ধ মহল।

এমনই ঘটেছে নওগাঁর মান্দা উপজেলায়। প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় খামারিদের সহায়তা প্রদানের নামে লাখ লাখ টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা অভিমাণ্য চন্দ্রের বিরুদ্ধে। একটি সংঘবদ্ধ চক্রের মাধ্যমে সুকৌশলে খামারিদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। অভিযোগ রয়েছে, প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার আশ্রয়ে এই চক্রের সাথে জড়িত রয়েছে রেজিস্ট্রেশনবিহীন কথিত ভেটেরিনারি ডাক্তার, এলাকার প্রভাবশালী ও ফড়িয়ারা। এখন পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা।

জানা গেছে, উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের প্রায় ১ হাজার ৫০০ জন পোল্ট্রি ও ডেইরি খামারির কাছ থেকে অভিনব উপায়ে টাকা আদায় করা হয়েছে। খামারভেদে প্রত্যেকের কাছে নেয়া হয়েছে ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা। করোনা ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার নামে এসব টাকা নেওয়া হয়েছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জেলা এবং উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা।

১৪টি ইউনিয়নে খামারিদের মাঝে সিন্ডিকেটের নির্ধারিত এজেন্টের মাধ্যমে চালানো হয়েছে প্রচারণা। কারো কাছে সরকারিভাবে খামার রেজিস্ট্রেশন করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আবার কারো কাছে প্রণোদনা সহায়তার ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকার প্রলোভন দেখানো হয়েছে। শুধুমাত্র প্রলোভনে কাজ না হলে দেওয়া হয়েছে সরকারিভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি। গত আগস্ট মাস থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত এসব টাকা নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রণোদনা সহায়তার ৩০ হাজার টাকা খামারিদের বিকাশ একাউন্টে ঢুকে যাবে। ফলে শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত প্রান্তিক খামারিরা নিজ উদ্যোগে স্থানীয় প্রভাবশালী, পরিচিত ভেটেরিনারি ডাক্তারের মাধ্যমে টাকা জমা দেয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা অভিমাণ্য চন্দ্রের কাছে। ১৪-১৫ জন এজেন্টের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করেন এই কর্মকর্তা।

কথা হয়েছে উপজেলার তেঁতুলিয়া, ভারশোঁ, কালিকাপুর এই তিন ইউনিয়নের টাকা তোলার দায়িত্বে থাকা কয়েকজন এজেন্টের সাথে। এদেরই একজন গ্রাম্য ভেটেরিনারি চিকিৎসক দুলাল হোসেন। তিনি এগ্রিকেয়ার২৪.কম’কে বলেন, ‘আমি ২ হাজার টাকা করে মোট ৯৭ জনের কাছে থেকে টাকা তুলেছি। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা স্যার আমাকে এভাবে টাকা তুলতে বলেছেন; তাই তুলেছি। আমার চেয়ে বেশি টাকা তুলেছেন খালেক ভাই (আরেক ভেটেরিনারি চিকিৎসক)। ডিসেম্বরের মধ্যেই খামারিদের প্রণোদনা দেয়া হবে বলে এসব টাকা তোলা হয়েছে। আমার কোন দোষ নেই। যা বলার স্যারকে বলুন।’

১১ নং কালিকাপুর ইউনিয়নের চক উদয়নারায়ন গ্রামের মাসুদ রানা এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, ‘প্রণোদনার টাকা পাওয়া যাবে প্রতিশ্রুতিতে ২ হাজার টাকা নিয়েছে। খামার রেজিস্ট্রেশন না করলে এই টাকা পাওয়া যাবে না বলেও জানানো হয়। ডিসেম্বর চলে গেলো কিন্তু টাকা পেলাম না। খামার রেজিস্ট্রেশনও হলো না। রেজিস্ট্রেশন হতে তো আর ৩-৪ মাস লাগে না।’

এই ইউনিয়ন থেকে প্রায় শতাধিক খামারির কাছে টাকা নেওয়া হয়েছে। টাকার বিষয়ে কাউকে না জানাতে দেওয়া হয়েছে হুমকি। একই এলাকার ডেইরি খামারি কামরুজ্জামান এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, ‘আমার কাছে টাকা নিয়েছে দুই হাজার। কাউকে বলতে নিষেধ করেছেন খালেক ডাক্তার। বললে টাকা পাওয়া যাবে না বলেছে। আর এও বলেছে, প্রণোদনার টাকা বিকাশ না আসলে আমার দুই হাজার টাকা ফেরৎ দিবে। এই টাকা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা নাকি নিচ্ছে। ওপর থেকে হুকুম এসেছে টাকা দিতে হবে।’

উপজেলার ৯ নং তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের শাটইল গ্রামের পোল্ট্রি খামারি আবুল হোসেন এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, “করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের সরকার টাকা দিবে এই বলে সবার কাছে থেকে আড়াই হাজার করে টাকা নিয়ে গেছে। এই এলাকার যতগুলো খামারি আছে; পোল্ট্রি, ডেইরি, ব্রয়লার, হাঁস, ছাগল; সবার কাছে টাকা নিয়েছে। খামার রেজিস্ট্রেশনের জন্য আগে গিয়েছি তখন দেয়নি। আর এখন প্রণোদনার টাকা পাওয়ার জন্য রেজিস্ট্রেশন লাগবে, তাই বলেছে পিড়কোর বাজারের পশু চিকিৎসক ছানোয়ারুল হক।”

৭ নং প্রসাদপুর ইউনিয়নের জোতবাজার (সরদারপাড়া) গ্রামের পোল্ট্রি খামারি আব্দুল জলিলের কাছে নেওয়া হয়েছে ২ হাজার টাকা। তাকে প্রণোদনা ও খামার রেজিস্ট্রেশনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। তিনি এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, “আমার এখানে টাকা তুলেছে পশু ডাক্তার সুমন। আমি তাঁর হাতে ২ হাজার টাকা দিয়েছি। সরকার নাকি আমাদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে কিছু সাহায্য করবে। ডিমের দাম নাই, ব্রয়লারের দাম নাই। আবার খাদ্যের দাম বেড়ে গেলো। টাকাটা পেলে খুব ভালো হতো।”

দফায় দফায় এসব পশু চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলে বেশিরভাগ সময় তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। কয়েকবার চেষ্টার পরে কথা হয় পশু ডাক্তার আব্দুল খালেকের সাথে। তার বিরুদ্ধে শতাধিক খামারির কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। টাকা উত্তোলনের কথা আংশিক স্বীকার করে তিনি এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, “আমাকে স্যার (প্রাণিসম্পদ কর্মকতা) হুকুম করেছেন তাই টাকা তুলেছি। আমি ২০-২৫টি খামারির টাকা তুলেছি। আবার যাদের থেকে টাকা নিয়েছি তাদের অনেকের কথাই ঠিকঠাক স্মরণ নেই। তাই বলা মুশকিল কার কার কাছে টাকা নেয়া হয়েছে।”

রেজিস্ট্রেশনের সাথে প্রণোদনা পাওয়ার কি সম্পর্ক জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি আসলে এ বিষয়ে তেমন জানিনা। আমাকে যা বলা হয়েছে আমি তাই করেছি। এরকম নিয়ম আমার জানা নেই। টাকা পাওয়া যাবে ডিসেম্বরের মধ্যেই এই কথা বলে টাকা নেওয়া হয়েছে।”

সরেজমিনে গিয়ে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের একাধিক পোল্ট্রি ও ডেইরি খামারিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা নিজে নয়, বিভিন্ন এজেন্টের মাধ্যমে টাকা তুলেছেন। অভিযোগ রয়েছে, চিকিৎসার জন্য উপজেলার কোথাও গেলেই তিনি ১ হাজার টাকা ফি আদায় করতেন। উপজেলায় পাওয়া যায় না কোন ভ্যাকসিন কিংবা জরুরি ঔষুধ। নামে-বেনামে কোম্পানির ঔষুধগুলো চড়া দামে কিনতে হয় খামারিদের।

প্রণোদনার নামে টাকা নেওয়ার সরকারি কোন নীতিমালা আছে কি না জানতে চাইলে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা অভিমাণ্য চন্দ্র এগ্রিকেয়ার ২৪.কমকে বলেন, “সরকারি সহায়তার নামে কোন টাকা নেওয়ার নিয়ম নেই। প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প থেকে তথ্য চাওয়া হয়েছে। তাই আমরা খামারিদের কাছে থেকে ভোটার আইডি, ছবি, ঠিকানাসহ বিভিন্ন তথ্য নিয়েছি।”

সহায়তার নামে খামারিদের কাছে থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা টাকা নিয়েছি রেজিস্ট্রেশনের নামে। তবে, কতজনের কাছে থেকে টাকা নিয়েছি সে বিষয়ে আপনাকে দু-দিন পর জানাব।” এরপর দফায় দফায় ফোন করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

প্রান্তিক খামারিদের কাছে থেকে প্রণোদনার নামে টাকা নেওয়ার বিষয়ে কথা হয় নওগাঁ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মহির উদ্দিনের সাথে। তিনি এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, “সরকারি সহায়তা দেওয়ার নামে কেউ কোন অর্থ আদায় করতে পারবে না। টাকা তোলা হয়েছে এ বিষয়টি আপনার কাছেই প্রথম জানলাম। প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প থেকে খামারিদের তথ্য চাওয়া হয়েছিল, আমরা শুধু তথ্য দিয়েছি। খামারিরা সেখান থেকে কত টাকা পাবে কিংবা ‘কি’ পাবে সে বিষয়ে কোন সরকারি নোটিস বা ঘোষণা নেই। আমি বিষয়টি দেখব।”

উল্লেখ্য, প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ক্ষতিগ্রস্থ খামারিদের প্রণোদনা দেয়ার আশ^াস দিয়েছে বিশ^ব্যাংক এমনটা জানিয়েছেন প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা। এজন্য প্রকৃত খামারিদের তথ্য চেয়েছে বিশ্বব্যাংক। তাই এ্যাপসের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। রেজিস্ট্রেশনভূক্ত ও এর বাইরের খামারিরাও এই আর্থিক অনুদান প্রাপ্তির যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।