মেহেদী হাসান, নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী: জীবন যেখানে থমকে দাঁড়ায় কিছু উদ্যোমী মানুষ সেখান থেকেই শুরু করে। যোগাযোগ ব্যবস্থা কিংবা শিক্ষার উপযোগী পরিবেশ চরাঞ্চলে না থাকলেও কৃষির জন্য উর্বর ভূমি হিসেবে বেশ পরিচিত। পশুপালন, ফলমূল, সবজি চাষ সবই এখন প্রযুক্তির আশির্বাদ পুষ্ট। তেমনই চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রত্যন্ত চরের এক শিক্ষিত খামারি ফরহাদ রেজার গল্পটা ঠিক যেন বেকারের জীবনের অনুপ্রেরণা।

জেলার সদর উপজেলার চরবাগডাঙ্গা ইউপির ৬ নং গড়াইপাড়া এলাকার মো: ফরহাদ রেজা।  শফিকুল ইসলাম পেশায় মাদ্রাসা শিক্ষক। ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে ছিলেন বেশ অনুরাগী। তাই উচ্চতর ডিগ্রির জন্য ছোট ছেলে ফরহাদ রেজাকে পাঠান বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে। ফরহাদ মাধ্যমিক শেষে ভর্তি হন রাজশাহী কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। করোনার শুরুতে হাতে এসে যায় সম্মান সার্টিফিকেট। শিক্ষিত বেকারের তালিকায় নাম এসে যায় ফরহাদের।

পড়তে পারেন: তিন দশকের সফল খামারি গোলাম রাহিদ

গত ১ সেপ্টেম্বর সরেজমিনে সাক্ষাৎ হয় তাঁর সাথে। নিয়ে যান আমের সারি সারি গাছের আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে লেয়ার মুরগির খামারে। চরের বুকে দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন জাতের আম গাছ। চারিদিক ফাঁকা। দূর থেকে মাথা উঁচু করে জানান দিচ্ছে কিছু একটা আছে। ১ হাজার লেয়ার মুরগির খামার করেছেন তিনি। তাতে প্রতিদিন আয় হচ্ছে ১‘২’শ থেকে ১৫’শ টাকা। তাতে মাসে মিলছে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। এই পরিমাণটা আরো বেশি কিছু ছিল দু-সপ্তাহ আগে। ডিমের দাম কমে যাওয়ায় লাভের ছানায় ছুরি পড়েছে কিছুটা!

ফরহাদ এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, “আমি মাস্টার্স পাশ করে বেকার হয়ে পড়ি। চিন্তা করে কিছুই পাচ্ছিলাম না। বাড়িতে এসে কিছু করতে চাইলে সবাই বললো- এতো পড়াশোনা করে মুরগির খামার করলে সম্মান থাকে? আমি আমার নিজের আত্মবিশ^াস আর আল্লাহর উপর ভরসা রেখে নেমে গেলাম। আমার কাছে আমি সফল।”

পড়তে পারেন: দেশে ব্রাহমা মুরগির খামার, জোড়ার দাম ২৫ হাজার!

“শুরু করাটা ছিল অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। এই এলাকায় মাস্টার্স পাশ করা খামারি আমি একা। তাই এলাকায় শিক্ষিত খামারি হিসেবে বলে অনেকেই। আমি সবসময় জৈব নিয়ন্ত্রণের ব্যপারটা খেয়াল করি। মুরগির অসুখ হয়না। শুরু থেকেই আমি মুরগি সুস্থ রাখার ব্যাপারে সচেতন।”

ফরহাদ বলেন, আমার এক বন্ধু এই লেয়ার খামার করেছে। লাভ-লোকসান নিয়ে হিসেব নিকাশ করে আমিও নেমে পড়লাম। প্রথমে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে মুরগি যখন ডিম দিতে শুরু করে। করোনা আসার পর ডিমের দাম না থাকায় লোকসান হয়, সেই বছরে। তারপর মুরগি নিয়ে বর্তমান মুরগির ডিম এসে ৯ মাস চলছে।

“আমি দমে যাইনি। ঘর-কাঠামো সবকিছু রেডি থাকার কারণে আরেক দফা বাচ্চা তুলি। এরপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। খামারে আমার বড়ভাই আর আমি কাজ করি। লিটার সরাতে হয়না। পানি দিয়ে ধুয়ে দিই। ডিম নিয়ে যায় খামার থেকেই। কিন্তু বাজারের তুলনায় কিছুটা কম দেয়। তাতে লোকসান হয়না; লাভ হয় মোটামুটি।”

পড়তে পারেন: ১ হাজার লেয়ার মুরগি পালন ও ডিমের লাভ-খরচের হিসাব

প্রত্যন্ত চর অঞ্চলে মুরগির খামার কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে ডাক্তার নাই। ফিডের বস্তা চাঁপাই সদর থেকে আনাতে হয়। বস্তায় খরচ পড়ে ৫০ টাকা বেশি। তারপরও দিনে আগে দেড় হাজার থেকে ১২’শ টাকা লাভ আসতো। এখন কমে গেছে। খাদ্যের দাম বাড়ার কারণে অর্ধেক লাভ নাই হয়ে গেছে। আগে ১৭’শ পঞ্চাশ টাকায় ৫০ কেজির বস্তা কিনতাম এখন সেই খাদ্য ২৯’শ টাকা। আগে ডাক্তার রাজশাহী থেকে নিয়ে আসলে ৫০০ টাকা দিলেই হতো। এখন ১ হাজার দিতে হয়। তারপরও লাভ হয়। তা না হলে তো আর টিকে থাকা যেতো না।

সফলতার পেছনে কৌশল জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার মুরগি আর এক মাসের মধ্যে ডিম দিবে। ১৩০ দিন বয়সে ডিম আসে যদি মুরগির ওজন ঠিক থাকে ও সুস্থ থাকে। দিনে দুইবার খাবার দিই। সকাল ৬ টার দিকে একবার আর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে একবার। রাতে খাবার দিই না। অতিরিক্ত খাবার দিলে খামারে লাভবান হওয়া সম্ভব নয়। ভালো কোম্পানির ভ্যাকসিন ও মেডিসিন ব্যবহার করলে লাভবান হওয়া যাবে। আর খেয়াল রাখতে হবে মুরগি ভালো আছে কিনা। আর এসব কৌশল শিখিয়ে দিয়েছেন এই এলাকারই খামারি ফারুক হোসেন ভাই।

পড়তে পারেন: চাকরি ছেড়ে লেয়ার মুরগিতে বাজিমাত ইরাক ফেরত ফারুকের

প্রতিবেশিরা জানান, ফরহাদ হোসেন মুরগির খামার করেছেন আমের বাগানের ভেতর। কারো কোন সমস্যা হয়না। এই খামারেই তার ভাগ্য খুলেছে। প্রথম প্রথম একটা শিক্ষিত যুবক গ্রামে এসে কিছু করতে চাইবে তা কারোর কাছে ভালো লাগবে না। নেগেটিভ কমেন্টস টা বেশি থাকে। তারপরও ফরহাদ নিজের আত্মবিশ^াসে এগিয়ে গেছেন।

খামার দেখাশোনা ও ভ্যাকসিনেশন কাজ করেন প্রাণিসম্পদের আতাউর রহমান। তিনি এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, ফরহাদ হোসেন অত্যন্ত যত্নশীল একজন খামারি। তেমনই আরেকজন খামারি ফরহাদ হোসেন। তাঁর খামারের কোন সমস্যা হলে সাথে সাথে জানান। চিকিৎসার কোন ঘাটতি থাকে না। পরামর্শ মেনে চলেন। সময় মতো টিকার ব্যবস্থা করেন তাই তিনি একজন সফল খামারি। আধুনিক খামারির তালিকায় তিনি পড়বেন। শিক্ষিত খামারি হিসেবে তাঁর সুনাম রয়েছে এলাকায়।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ