মেহেদী হাসান, রাজশাহী, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: যীশুখ্রীষ্টের জন্মের ৫০০-৬০০ বৎসর আগে রোমানীয়দের দ্বারা সর্বপ্রথম গৃহপালিত ব্যবস্থায় স্বাস্থ্যসম্মত আরামদায়ক পদ্ধতিতে মোরগ-মুরগি পালন শুরু হয়েছিল। আধুনিককালে জীবাণুমুক্ত উর্বর ডিম থেকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বাচ্চা ফুটানো হয়। বর্তমানে দেশে একদিন বয়সী মুরগীর বাচ্চা উৎপাদন প্রযুক্তির সফল ব্যবহার না বলে পারা যায় না।

বৈশ্বিক অনুমান করা হয় যে ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী ১ বিলিয়ন গবাদি পশু এবং ৭৬৭ মিলিয়ন শূকর ছিল। ২০১৮ সালে ৯৯৬ মিলিয়ন মুরগি ছিল যার সংখ্যা বিশ্বব্যাপী মানুষের জনসংখ্যার চেয়ে তিনগুণ বেশি। প্রাকৃতিক পরিবর্তন ও নানান বিষয় বিবেচনায় কয়েকটি প্রাণিসম্পদ খাতে পরিবর্তন আনতেও দেখা গেছে ইতোমধ্যেই।

বর্তমানে দেশে মোট মাংসের চাহিদার শতকরা ৪০-৪৫ শতাংশ আসে পোল্ট্রি থেকে। এই বৃহৎ সংখ্যার অর্ধেকের বেশি আসে বাণিজ্যিক ব্রয়লার থেকে। আমরা যে ব্রয়লার মুরগি খাই তা পুরোটাই আমদানি নির্ভর। ফলে বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু উপযোগী জাতের সংকট পোল্ট্রি খাতে রয়ে গেছে এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। ব্রয়লার মুরগির মাংস অনেকেই খেতে পারেন না বা ইচ্ছে করেই পাতে তোলেন না। ব্রয়লারের স্বাদ নেই এমন অভিযোগ তো রয়েছেই। এমন সময়ে আশার আলো হিসাবে নতুন জাতের মুরগি এলে কেমন হয়!

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই)-এর পোল্ট্রি উৎপাদন গবেষণা বিভাগের বিজ্ঞানীরা এ সমস্যার সমাধানে বছর দু’এক আগে একটি অধিক মাংস উৎপাদনকারী মুরগির জাত উদ্ভাবন করেন। আর সেই জাতের নাম দেন “মাল্টি কালার টেবিল চিকেন (এমসিটিসি)।

নাম দেখেই অনুমান করতে পারছেন যে একাধিক রঙের মিশ্রণ রয়েছে এই মুরগিতে। বিএলআরআইয়ের পোলট্রি উৎপাদন গবেষণা বিভাগের বিজ্ঞানীরা দেশীয় জার্মপ্লাজম ব্যবহার করে ধারাবাহিক সিলেকশন ও ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে এই অধিক মাংস উৎপাদনকারী মুরগির জাত উদ্ভাবন করেছেন। প্রয়োজনীয় গবেষণা ও খামারি পর্যায়ের ফলাফল পর্যালোচনা করে সঠিকভাবে সম্প্রসারণ করতে পারলে খামারিরা বেশি লাভবান হতে পারবেন। এটি বিএলআরআই উদ্ভাবিত সোনালি জাতের মুরগির চেয়েও বেশি উন্নত মানের।

আমাদের দেশে পোল্ট্রি সেক্টরে অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত লোক নিয়োজিত। যারা ঠিকমতো মুরগির খামারের পরিচর্যা করতে ব্যার্থ। এতে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, মাইকোপ্লাজমার আক্রমণে খামার উজাড় হয়ে যায়।

বিজ্ঞানীরা এ নতুন জাত নিয়ে প্রায় দশ বছর ধরে তাদের খামারে গবেষণা চালাচ্ছেন। বর্তমানে এ মুরগির উৎপাদন দক্ষতা, বয়সভেদে পুষ্টির চাহিদা, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ইত্যাদির ওপর জোর গবেষণা করছেন। মুরগির ভ্যাকসিন তালিকা প্রণয়ন, লাভ-ক্ষতির অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ, মাংসের গুণাগুণ ও ভোক্তা পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করবেন তারা।

এমসিটিসি জাতের মুরগি পালনে জায়গার পরিমাণ, ব্রিডিং তাপমাত্রা, আলো ও বায়ু ব্যবস্থাপনা অনান্য মুরগির মতই। এ জাতের মুরগি গুলোর মৃত্যুর হার খুবই কম। তারা জানায় তাদের পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণায় সর্বোচ্চ ১.৫% মৃত্যুহার পাওয়া গেছে। এই জাতের মুরগিগুলো অধিক রোগ প্রতিরোধক্ষম এবং দেশীয় আবহাওয়া উপযোগী হওয়ায় সঠিক বায়োসিকিউরিটি বা জীব-নিরাপত্তা এবং প্রতিপালন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারলে রোগ-বালাই থেকে অনেকাংশে মুক্ত থাকতে পারে ।

ইউএসডিএ লাইভস্ট এন্ড পোল্ট্রি ও ওর্য়াল্ড মার্কেট এন্ড ট্রেডের মতে পোল্ট্রি হলো বিশ্বের সবচেয়ে বেশি খাওয়া মাংসের মাঝে দ্বিতীয়। বিশ্বে ৩৮% মাংসের চাহিদা মেটায় শুকর, যার পরেই রয়েছে পোল্ট্রি মাংস যা ৩০% মাংসের চাহিদা মেটায়। বার্ষিক ১৬বিলিয়ন পাখি পালন করা হয়, যার অর্ধেক শিল্পকারখানায়। বৈশ্বিক ব্রয়লার মাংসের উৎপাদন ২০১৩সালে বেড়েছে ৮৪.৬ মিলিয়ন টন। সবচেয়ে বেশি উৎপাদক ছিল যুক্তরাষ্ট্র (২০%), চীন (১৬.৬%), ব্রাজিল (১৫.১%) এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (১১.৩%)।

এ জাতের মুরগিগুলোর এক দিন বয়সে হালকা হলুদ থেকে হলুদাভ, কালো বা ধূসর রঙের পালক থাকে। পরে দেশি মুরগির মতোই মিশ্র রঙের হয়। এ পর্যন্ত গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, এমসিটিসি মুরগিগুলোর আট সপ্তাহে গড় ওজন হয় এক কেজি (মোরগের ক্ষেত্রে ওজন ১১০০-১২০০ গ্রাম হয়ে থাকে)। আট সপ্তাহে গড় খাদ্য গ্রহণ করে ২ দশমিক ২০ থেকে ২ দশমিক ৩০ কেজি। বিএলআরআই পরিচালিত ধারাবাহিক গবেষণায় সর্বোচ্চ ১ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত মৃত্যুহার পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে।

বৈশ্বিক তাপমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধির কারণে বিশ্বের ঝুকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তালিকার প্রথম দিকে। প্রতিনিয়ত পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রভাব কম-বেশি সব খাতের উপরই দৃশ্যমান। জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিশ্বে বাংলাদেশে উদ্ভাবিত এ এমসিটিসি জাতের মুরগি নতুন সম্ভবনা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ, এরা পরিবেশ মানিয়ে নিতে পারে। সেইসাথে যারা ব্রয়লার মুরগি খাবারের পাতে তোলেন না তাদের মাংস খাওয়া ফিরিয়ে আনতে পারে এই নতুন জাতের মুরগি।