মেহেদী হাসান, নিজস্ব প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: আদনান শফিক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। পড়াশুনা প্রায় শেষ প্রান্তে। চাকরির পিছনে না ছুটে হতে চান উদ্যোক্তা। বেছে নিয়েছেন স্বল্প জায়গায় অধিক ঘনত্বে মাছ চাষ পদ্ধতি বায়োফ্লক। বায়োফ্লকে স্বপ্ন দেখেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এই শিক্ষার্থী। কিন্তু নানা সমস্যায় মুখ ফিরিয়ে নিলেন, তাঁর স্বপ্ন পূরণ হলো না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তির পর থেকেই মনে মনে স্বপ্ন বুনতে থাকেন উদ্যোক্তা হবেন। ক্যাম্পাস জীবনের বছর দুয়েক না পেরুতেই শুরু করেন পরীক্ষামূলক সবজি চাষ। প্রথমেই ব্রকলি চাষে সফলতা পান তিনি। এরপর আলু, মূলা, কপি, পালং, ড্রাগনসহ প্রায় ১০-১২টি সবজির টাকা দিয়ে গড়ে তুলেছেন প্রায় ৪০ হাজার লিটারের ৩টি বায়োফ্লক ট্যাংক। এখন দিনে দিনে স্বপ্নের চারাগাছ মরে যেতে শুরু করেছে। হতাশায় বায়োফ্লক থেকে সরে দাঁড়ালেন এই তরুণ।

আদনান শফিকের পরিকল্পনায় ছিল, নতুন করে পুকুর খনন করে মাছ চাষ করার কিংবা পুকুরে মাছ চাষ অনেকটাই আশঙ্কাজনক এবং ঝুঁকিপূর্ণ। কখন কি হয় বলা যায় না। তাছাড়া খরচ, উৎপাদন কম। বেশ কয়েক বছর ধরে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের প্রযুক্তি বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে। এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে কোনো পুকুর, খাল-বিল কিংবা নদী-নালার প্রয়োজন হয় না। বরং অল্প জায়গায় ইট-সিমেন্ট দিয়ে ট্যাংক কিংবা ত্রিপল দিয়ে ঘের তৈরি করে টানা কয়েকবছর মাছ চাষ করা যায়। আয়ও করা যায় উল্লেখযোগ্য। এ ধারণা থেকেই মাছ চাষে আগ্রহ জন্মেছিল তাঁর।

জানা গেছে, কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার আনোয়ারখালি গ্রামের আব্দুল মতিনের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে আদনান শফিক। প্রথবস্থায় ইউটিউবে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরামর্শ নেন এক মাছচাষি বড় ভাইয়ের কাছে। হাতে কলমে মাছ চাষের বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন তাঁর কাছে। এবার প্রশিক্ষণ শেষে পড়ালেখার পাশাপাশি বাড়তি কিছু আয়ের লক্ষ্যে প্রথম এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু করেন।

ভাড়া বাসায় থাকতেন নগরীর ডাবতলা এলাকায়। সেখান থেকেই পাশের ফাঁকা জমি লিজ নেন সবজি চাষ ও মাছ চাষের জন্য। ২০২০ সালের শুরুর দিকে তিনটি ট্যাংকসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করেন তিন বন্ধু। টিউশনি আর পরিবার থেকে সামান্য টাকায় কঠোর মনোবলে নেমে পড়েন কৃষিকাজ ও মাছ চাষে।

বৃহস্পতিবার (৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১) কথা হয় আদনান শফিকের সাথে। বায়োফ্লকে মাছ চাষে তিনি তুলে ধরেন বেশ কয়েকটি সমস্যার কথা। আর এসব সমস্যার কথা বিবেচনা করেই নিজেকে গুটিয়ে নিলেন বায়োফ্লকে মাছ চাষ থেকে।

শফিক জানান, আমার একটি ট্যাংক ১৮ হাজার, আরেকটি ১৫ হাজার এবং আরেকটি ছোট ৭-৮ হাজার লিটার পানি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন। এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ ঝুঁকিপূর্ণ। পানির অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক না থাকলে মাছ মারা যাবে। সার্বক্ষণিক নজর রাখার জন্য একজন মানুষ থাকতেই হবে। ১০ ঘন্টার জন্য বাইরে কোথাও ব্যক্তিগত কাজে গেলে এরমধ্যে যদি কারেন্ট চলে যায় তাহলে সব মাছ মরে ভেসে উঠবে। তাছাড়া আমার মতো অনেকেই ফেসবুক, ইউটিউবের ভিডিও দেখে হুটহাট করে প্রজেক্টে নেমে পড়েন। ইনভেস্ট করেন লাখ লাখ টাকা। শেষে সফল হতে পারেন না, লোকসানে হতাশা ঘিরে ধরে।

তিনি আরো বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মৎস্য দপ্তরের কর্মকর্তাদেরও বায়োফ্লকে মাছ চাষের তেমন কোন অভিজ্ঞতা নেই। চাষিদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নেই কোন সহায়তা। দামের নিশ্চয়তা নেই। এখন মাছ চাষ করে উৎপাদন খরচ উঠবে কিনা সন্দেহ। বায়োফ্লকে মাছ চাষ করে কতজন লাভবান হয়েছেন এটা জানতে ইচ্ছে করে! তারপরেও হ্যাঁ, কেউ যদি এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে আগ্রহী হন তাহলে তাঁকে এ বিষয়ে বিস্তর জানতে হবে। সফল যারা হয়েছেন তাদের কাছে থেকে পরামর্শ নিতে হবে।

বায়োফ্লকে জন্য খাবার খুব কম দিতে হয়। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছের উচ্ছিষ্ট এবং নষ্ট হয়ে যাওয়া খাবার ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে প্রক্রিয়াকরণ করে তা পুনরায় মাছকে খাওয়ানো যায়। এতে খাবারের খরচ অনেক কমে যায়। মাত্র ৬০০-৭০০ গ্রাম খাবার খাইয়ে এককেজি মাছ উৎপন্ন করা যায়। অথচ এককেজি মাছ উৎপাদনে খরচ হয় ৮০-৯০ টাকা।

বায়োফ্লকে মাছ চাষের সমস্যা বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা মৎস্য মৎস্য কর্মকর্তা অলক কুমার সাহা এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, বায়োফ্লকে মাছ চাষ শতভাগ প্রযুক্তি নির্ভর। অনেকেই ইফটিউব ফেসবুকে ভিডিও দেখে, মানুষের কাছে থেকে মৌখিকভাবে শুনে মাছ চাষ শুরু করেন। পরবর্তীতে লোকসান গুণতে হয়।

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ বিষয়ে আগে কর্মকর্তাদের ট্রেনিং করানো হচ্ছে। এরপর চাষি পর্যায়ে ট্রেনিং করানো হবে। না জেনে ব্যক্তিগত উদ্যোগে মাছের চাষ শুরু করেছেন। কিন্তু এই পদ্ধতিতে বৈজ্ঞানিক কিছু বিষয় আছে যা জানা জরুরি। না জেনে মাছ চাষ শুরু করে লোকসান খেয়ে বায়োফ্লককেই দায়ী করছেন। আসলে এটি খুবই লাভজনক একটি পদ্ধতি।