মেহেদী হাসান, নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী: রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোর জেলা নিয়ে গঠিত হয়েছে রাজশাহী কৃষি অঞ্চল। কৃষকদের দাবি চলতি বোরো মৌসুমে এ অঞ্চলে এবার বৈরি আবহাওয়া, মাকড়ের আক্রমণের কারণে বিঘাপ্রতি ধানের ফলন গড়ে কমে গেছে প্রায় ৫ থেকে ৮ মণ। কৃষি বিভাগের দাবি বিঘাপ্রতি গড়ে ২ মণের কাছাকাছি কমলেও এ বিপুল পরিমাণ ফলন কমেনি।

রাজশাহী বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এই অঞ্চলে বোরো মৌসুমে মোট ৩ লাখ ৬৭ হাজার ৩১৪ হেক্টর জমিতে ধান চাষ করা হয়। গতবছরের তুলনায় এবার রাজশাহী কৃষি অঞ্চলে ধানের ফলন কমেছে শূন্য দশমিক ১১ মেট্রিকটন। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪ দশমিক ২৪ থাকলেও এবার তা ৪ দশমিক ১৩ তে নেমে এসেছে। এতে বিঘায় ফলন প্রায় ২ মণের মতো নাই হয়ে গেছে। অপরদিকে কৃষকদের দাবি, এ ক্ষতির পরিমাণ তিনগুণেরও বেশি।

পড়তে পারেন: জনপ্রিয় হচ্ছে জিঙ্কসমৃদ্ধ নতুন ধান ‘বঙ্গবন্ধু-১০০’

বোরো মৌসুমের শুরুটা বেশ সুখকর ছিল চাষিদের। আবহওয়াও ছিলে কৃষকের পক্ষে। আসল সমস্যা দেখা দেয় তাপমাত্রা। ধানের শিস বের হওয়ার সময়ে মার্চ-এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে রাজশাহীর গড় তাপমাত্রা দাঁড়ায় ৩৭-৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা হিটশকে পরিণত হয়। ফলে পুরনো ব্রিধান-২৮ ও ২৯ জাতের সাথে জিরা ধানে বেশ প্রভাব ফেলে। অথচ রাজশাহী ও নওগাঁ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় ব্রি ২৮ ও জিরা ধান। পরবর্তীতে মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দেয় বাদামী গাছ ফড়িং যা “কারেন্ট পোকা” হিসেবে কৃষকরা চিহ্নিত করেন। এতেও কমে ধানের ফলন।

কৃষকরা বলছেন, কাটারিভোগ জাতের ধান ও যেসব ধান হেলে পড়েনি সেসব ধানের ভালো ফলন হয়েছে। কিন্তু বৃষ্টিপাত ও ঝড়ো হাওয়ায় জমির ধান গাছ নুয়ে পড়ে। হেলে পড়া ধানের শ্রমিক ব্যয় বেড়ে ধানের ফলনে “বোঝার উপর শাকের আঁটি” হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পড়তে পারেন: নতুন ধান দুলালী সুন্দরী চাষে আগ্রহ বাড়ছে চাষিদের

এ কৃষি অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে আগে ধান পাকে নাটোর ও নওগাঁ জেলায়। নওগাঁর মান্দা উপজেলার অন্তর দশ জন চাষির সাথে কথা বলে জানা গেছে- কারেন্ট পোকার আক্রমণে ২৮ ধানের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। জেলায় বড় বড় বিলে চাষ হয় ধান। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় হেলে পড়া ধান পানির সংস্পর্শে চলে আসে ফলে গলসে (ধানে পচন) গেছে। যেখানে বিঘায় ২৭-২৮ মণ ধান পাওয়া যেতো সেখানে এবার সর্বোচ্চ ১২ থেকে ১৫ মণ পাওয়া গেছে।

মান্দার ১ নং ভারশোঁ এলাকার জফের মন্ডল (৫০) ৫ বিঘা ধান কেটে ওজন করতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান ধানের গোলাতেই। ধান মেপে দেখেন ৫০ মণ। এতেই তার মাথা খারাপ হয়ে যায়! হিসাবে বিঘাতেই ১০ মণের বেশি নাই হয়ে গেছে।

এছাড়া গত শনিবার (১৪ মে) রাজশাহী জেলার পবা, তানোর, মোহনপুর ও গোদাগাড়ী উপজেলার বেশ কয়েকটি এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ ধানি জমিতেই গাছগুলো নুয়ে পড়েছে। আবার গত কয়েক দিনের ঝড়-বৃষ্টির কারণে মাঠে জমেছে হাটুপানি। এতে নুয়ে পড়া ধানগুলো প্রায় ডুবে গেছে পানির মধ্যে। অনেকে আধা-পাকা ধান কেটে তুলছেন।

পড়তে পারেন: নতুন জাত উদ্ভাবন, একটি ধানের জায়গায় ৯টি ধান

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, হঠাৎ ঝড়-বষ্টি হওয়ায় রাজশাহী অঞ্চলের অধিকাংশ ধান গাছ নুয়ে পড়ে। এ কারণে কৃষি পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করার চেষ্টাও করেন তারা। মাঠ পর্যায়ে চারগুটি একসাথে বেঁধে নুয়ে পড়া ধানকে পুনরায় দাঁড় করানোর পন্থা শেখানোর চেষ্টা করেন। তানোরে এ পদ্ধতি শেখানোর কাজ করেন অতনু সরকার নামে এক কৃষি কর্মকর্তা। তাতে তেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি।

পবা উপজেলার আব্দুল লতিফ নামের এক কৃষক জানান, বৃষ্টির কারণে ধান খেতে হাটু পানি জমে আছে। আর তাই গোড়াসহ ধান গাছগুলো পচতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে ধান না কাটলে আউড়ের (খড়) দামও মিলবে না। তিনি জানান, এক বিঘায় প্রায় দুই হাজার টাকার খড় বিক্রি হয়।

পড়তে পারেন: সময়ের দেড়মাস আগেই কাটা যাবে নতুন জাতের ধান

গোদাগাড়ী উপজেলার বসন্তপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. রফিকুল ইসলাম। বসন্তপুরের বিলে দুই বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছিলেন। সবমিলিয়ে ধান আবাদে খরচ হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। তিনি জানান, দুই বিঘায় এবার প্রায় ৫০ থেকে ৫৫ মণ ধান পাবার কথা ছিল। ধান নুয়ে পড়ায় এখন এর অর্ধেকও পাওয়া যাবে না। নুয়ে পড়া ধানে চিটা ধরে (নষ্ট হয়)। তাই বাজারে এ ধান বিক্রি করতে গেলেও ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি করতে হবে। তাও কেউ কিনতে চাইবে না। কিনলেও এসব ধান পুকুরে মাছের খাবার অথবা গরু কিংবা হাঁস-মুরগির খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করবে। আবার এই ধানই ঝড়ের কারণে ক্ষতি না হলে বাজারে দাম পেতাম ১১০০ থেকে ১২০০ টাকা।

রাজশাহী জেলায় আনুমানিক কত হেক্টর জমির ধান নুয়ে পড়েছে তা জানতে চাওয়া হয় রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ হিল কাফীর কাছে। তিনি বলেন, আমাদের কাছে ধান নুয়ে পড়ার তেমন কোনো তথ্য নেই। সাধারণত বক্ল সুপারভাইজারেরা এসব তথ্য দিয়ে থাকেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা এমন কোনো ধরনের তথ্য সরবরাহ না করায় জানাতে পারছি না। তবে কৃষকদের নুয়ে পড়া ধানের বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

পড়তে পারেন: হাওরে ঝুঁকি কমাতে আগাম জাতের ধান বীজ দেবে সরকার

জানতে চাইলে রাজশাহী ধান গবেষণা ইন্সিটিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ধান গবেষক ড. ফজলুল হক বলেন, ঝড়ের কারণে নুয়ে পড়া ধান গুলোর বিষয়ে কৃষদের বলা হয়েছে- যদি ধান খেতে পানি জমে থাকে তবে তা যেনো গোড়া সহই তুলে নেওয়া হয়। আর অল্প পানি থাকলে তা কেটে ফেলতে হবে। অন্যথায় ধান সহ গাছ পচে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। তবে ধানের গোড়ায় কোন প্রকারের জলাবদ্ধতা না থাকলে চারগুটি এক সাথে বাঁধলে সেটি পুনরায় দাড়িয়ে যাবে এবং তাতে ফসলেরও কোন ক্ষতি হবে না।

রাজশাহী বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ খয়ের উদ্দিন মোল্লা  এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, ধানের ফলন গতবারের তুলনায় এবার কম হবে। এখন পর্যন্ত রাজশাহী কৃষি অঞ্চলে ৫০ শতাংশ ধান কাটা শেষ হয়েছে। ঝড়ের কারণে ধান হেলে গিয়ে বিঘাপ্রতি প্রায় ২ মণের বেশি ফলন কমে গেছে। গতবার বিঘায় ২২ মণের বেশি ধান পাওয়া গেলেও এবার তা ২০ মণ হিসাবে পাওয়া গেছে।

বাঁকি ৫০ শতাংশ ধানের ফলন কমার আশঙ্কা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ধানের দানা হওয়ার আগে যেসব ধান পড়ে গেছে সেসব ধানের ফলন কমেছে কিন্তু ধান পাকার পর মাথা ভারি হয়ে পড়ে গেলে ফলনে খুব কম হয়না। এতে সমস্যা নাই।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ