ইউসুফ আলী সুমন, মহাদেবপুর (নওগাঁ) প্রতিনিধি: নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক কমিয়ে ভরা মৌসুমে বিদেশ থেকে অবাধে চাল আমদানি ও অদৃশ্য সিন্ডিকেটের কারসাজিতে বরেন্দ্র অঞ্চলের হাট-বাজারে হু-হু করে কমছে চলতি মৌসুমে উৎপাদিত আউশ ধানের দাম। এ নিয়ে ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাত দেখালেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন চাষিরা।

ধানের ফলনে খুশি হলেও দামে সন্তুষ্ট নয় তারা। গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতিমণ ধানের দাম কমেছে ২০০-২৫০ টাকা। তবে ধানের বাজারের সঙ্গে চালের দামে রয়েছে বিস্তর ফারাক। কেজিতে উৎপাদন খরচ ৪১-৪২ টাকা হলেও তা বিক্রি হচ্ছে ৫২-৫৫ টাকায়। এতে ব্যবসায়ীদের পকেটে প্রতি কেজিতে মুনাফা যাচ্ছে ১০-১২ টাকা।

কৃষকেরা বলছেন, কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় ধান চাষাবাদে বাড়তি খরচের ধকলে পুড়ছেন তারা। তবুও মিলছে না ন্যায্যমূল্য। সঠিক নজরদারির অভাবে ধান-চালের বাজার ব্যবসায়ীদের দখলে থাকছে বছরজুড়ে। ধানের দর কমায় ভরা মৌসুমে চাল আমদানি ও ব্যবসায়ীদের অদৃশ্য সিন্ডিকেটকে দুষছেন চাষিরা।

পড়তে পারেন: হারিয়ে গেছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী ধানের গোলা

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বড় বড় চালকলের মালিক, প্রভাবশালী মজুতদার সিন্ডিকেট ও কর্পোরেটদের নিয়ন্ত্রণে বাজার। তাই দিনদিন কমছে ধানের দাম।

কৃষি বিশেষজ্ঞ ও কৃষি অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ভরা মৌসুমে চাল আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করায় আমদানি বাড়ছে। এর প্রভাবে স্থানীয় বাজারে কমছে ধানের দাম। এতে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের পকেট ভারি হলেও ন্যায্যদাম থেকে বঞ্চিত চাষিরা। তাদের দাবি- সংশ্লিষ্টরা বাজার মনিটরিং করলেও তেমন একটা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০২২-২০২৩ খরিপ-১ মৌসুমে ১ লাখ ৭১ হাজার ৩৮০ হেক্টর জমিতে আউশ চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও এর বিপরিতে অর্জন হয়েছে ১ লাখ ৫১ হাজার ৩৭৮ হেক্টর। এসব জমি থেকে প্রায় ৬ লাখ ৮১ হাজার ২০১ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। চাষিরা জিরা, কাটারি, বিআর-২৬ ও ২১, ব্রি-২৮, ৫৬, ৬৫, ৮২, ৮৫, বিনা-১৯, পারিজা ও হাইব্রিড হীরা জাতের ধান চাষাবাদ করেছেন। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বরেন্দ্র অঞ্চলে শতকরা প্রায় ৬৫ ভাগ জমির ধান কাটা-মাড়াই সম্পন্ন হয়েছে।

পড়তে পারেন: ফড়িয়াদের কারণে ধানের দাম পাচ্ছেন না হাওড়ের কৃষক

দেশের অন্যতম ধান-চালের মোকাম এবং ধানের রাজ্য বলে পরিচিত উত্তরের জেলা নওগাঁয় এবার ৫৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আউশ চাষ হয়েছে। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের রাজস্ব খাতের অর্থায়নে নওগাঁ পৌরসভা ব্লকের বরুনকান্দি এলাকায় বাস্তবায়িত প্রদর্শনী প্লটের নমুনা শস্য কর্তন করে নওগাঁ সদর উপজেলা কৃষি বিভাগ।

বিনা-১৯ জাতের ধান কেটে মাঠেই মাড়াই-ঝাড়াই করে ফলন রেকর্ড করা হয়। হক্টেরে ফলন পাওয়া যায় ৫ দশমিক ৮ মেট্রিক টন। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক প্রজ্ঞাপনে চালের ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের কথা জানানো হয়েছে। পাশাপাশি চাল আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেদ্ধ চাল ও আতপ চাল আমদানিতে এ সুবিধা পাবেন ব্যবসায়ীরা।

পড়তে পারেন: উত্তরাঞ্চলে বাড়ছে ধানের উৎপাদন খরচ, কমছে চাষাবাদ

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের শীর্ষস্থানীয় ধান উৎপাদনকারী জেলা নওগাঁর বাজারে মৌসুমের শুরুতে ১২০০-১২৫০ টাকা মণ দরে আউশ ধান বিক্রি হয়েছে। গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতিমণে কমেছে ২০০-২৫০ টাকা। এ অঞ্চলের হাট-বাজারে ব্যবসায়ীরা প্রতিমণ ধান কিনছেন ৮৮০-৯৩০ টাকা দরে। এক মণ ধান থেকে ২২-২৩ কেজি পর্যন্ত চাল হয়ে থাকে। অর্থাৎ প্রতি কেজি চালে খরচ হচ্ছে ৪১-৪২। মিল পর্যায়ের ৪১-৪২ টাকার এই চাল বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫২-৫৫ টাকায়। চাষিরা ন্যায্যদাম থেতে চঞ্চিত হলেও ব্যবসায়ীদের পকেটে কেজিতে ১০-১২ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা যাচ্ছে।

অটো ও হাস্কিং মিলারদের হাতবদল হয়ে চাল আসে নওগাঁ ও মহাদেবপুরের বাজারে। নওগাঁর পৌর চাল বাজারে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে চালের দাম বেড়েছিল প্রকারভেদে কেজিতে ৭ টাকা পর্যন্ত। নতুন আউশ ধান বাজারে আসা ও সরকারের বেশকিছু কর্মসূচিতে কেজিতে চালের দাম ২-৩ টাকা কমেছে। কমতি দরে প্রতিকেজি মোটা চাল ৫২-৫৫ টাকা; আর চিকন চাল ৬৮-৭৩ টাকায় কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। ধানের দাম কমলেও চালের দরে এর প্রভাব নামমাত্র। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাজারের চিত্রও প্রায় একই।

পড়তে পারেন: ধানের তুষের তেলের দিকে ঝুঁকছে ভারত

সরেজমিন কয়েকটি হাট-বাজার ও বিভিন্ন এলাকার মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে সোনালি ধান। কেউ কাটছেন, কেউ আঁটি বাঁধছেন। ভ্যান, ট্রলিসহ বিভিন্ন বাহনে করে কৃষকেরা খেত থেকে ধান তুলে বাড়ির উঠোনে মাড়াইয়ের কাজ করছেন। আবার কেউ কেউ সার, সেচ, হালভাড়াসহ উৎপাদন খরচ মিটাতে নতুন ধান বিক্রির জন্য হাট-বাজারে তুলছেন। দম ফেলার ফুরসত নেই তাদের। কৃষকের দিন কাটছে মহাব্যস্ততায়। ফসল ধরে তোলার এই চিত্র দেখা গেছে বরেন্দ্র অঞ্চলের জেলাগুলোর বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে। বাম্পার ফলন হলেও দাম নিয়ে হতাশ চাষিরা। গত মৌসুমের ন্যায় এবার তাদের মুখে নেই হাসির ঝিলিক।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত কয়েকজন কৃষি বিশেষজ্ঞ ও কৃষি অর্থনীতিবিদেরা বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলের ধান-চালকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কয়েকটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। বছরজুড়ে অদৃশ্য ক্ষমতাবলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে তারা। সিন্ডিকেটের সদস্যরা কর্তৃপক্ষের আশীর্বাদ পুষ্ট হওয়ায় এদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পায় না কেউই। মাঝেমধ্যে নামমাত্র মজুতদার বিরোধী অভিযান হলেও তেমন একটা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে না বাজার মনিটরিং এর দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা। এছাড়া ভরা মৌসুমে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের ধান চাষিরা। ন্যায্যদর না পেলে ধান উৎপাদন থেকে কৃষকেরা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

পড়তে পারেন: সর্বোচ্চে উঠেছে ভারতীয় চালের দাম

সাতক্ষীরার ভোমরা বন্দর দিয়ে চাল আমদানি করে নওগাঁর মেসার্স সোনালী ট্রেডার্স। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক সুমন দে সাংবাদিকদের বলেন, চলতি অর্থবছরের শুরুতে ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে সপ্তাহে গড়ে ১০-১২ ট্রাক চাল আমদানি করেছি। এসব চালের মধ্যে রয়েছে চিকন নাজির, মিনিকেট এবং মোটাজাতের স্বর্ণা ও রত্না।

তিনি বলেন, আমদানিকৃত নাজির চাল দেশীয় বাজারে কেজিপ্রতি ৬৭ টাকা, মিনিকেট ৬২-৬৩ এবং মোটাজাতের চাল প্রতিকেজি ৪৬ টাকা দরে বিক্রি করছি। তবে গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে চাল আমদানি বেড়েছে। গত বছর এ সময়ে সপ্তাহে মাত্র চার-পাঁচ ট্রাক চাল আমদানি করেছিলাম।

নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার সরস্বতীপুর গ্রামের চাষি ওসমান গনি বলেন, তিন বিঘা জমিতে পারিজা জাতের ধানের আবাদ করেছি। কাটা-মাড়াই করে ১৬ মণ ধান ৮০০ টাকা মণ দরে বিক্রি করেছি। প্রতি বিঘায় খরচ হয়েছে ৯ হাজার টাকার মতো। তিনি বলেন, এক বিঘা জমির ধান বিক্রি করে পেয়েছি ১২ হাজার ৮০০ টাকা। সব খরচ বাদ দিয়ে লাভ হয়েছে তিন হাজার ৮০০ টাকা।

পড়তে পারেন: ৫০ বছরে চালের উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ

উপজেলার উত্তরগ্রাম গ্রামের কৃষক মাজহারুল ইসলাম বলেন, ধানের বর্তমান বাজার মোতাবেক হিসাব করে দেখা যায় চালের মূল্য খুব বেশি হলে কেজিপ্রতি ৪০-৪২ টাকা। কিন্তু সেখানে ৫০-৫৫ টাকা কিভাবে দাম হয় হয়? লাভ করছে ব্যবসায়ীরা, আর ধান চাষিরা কোনো ফায়দা করতে পারছেন না বলে অভিযোগ করেন তিনি। একই কথা বলেন বরেন্দ্র অঞ্চলের আরও ৪০-৫০ জন কৃষক।

বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক তৌফিকুল ইসলাম বলেন, সরকার চালের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য আমদানি শুল্ক কমিয়ে দিয়েছে। শুল্ক কমায় ইতিমধ্যে চাল আমদানি বেড়েছে। এ ছাড়া ওএমএস ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। এসব কারণে স্বাভাবিক কারণেই চালের বাজারে প্রভাব পড়েছে। মোকামে চাল বিক্রি কমে যাওয়ায় মিলাররা বাজার থেকে ধান কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে বাজারে ধানের দাম প্রতিমণে ২০০ টাকা কমে গেছে। এ ছাড়া জ্বালানি তেল প্রতি লিটারে ৫ টাকা কমায় কিছুটা হলেও ধান-চাল পরিবহনে খরচ কমেছে। এসব কারণে চালের দাম কেজিতে ২-৪ টাকা পর্যন্ত কমেছে।

পড়তে পারেন: শীর্ষ চাল রপ্তানীকারক দেশগুলোয় চালের দাম বৃদ্ধি

সমাজতান্ত্রিক খেতমজুর ও কৃষক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি ও বাসদের নওগাঁ জেলা শাখার সমন্বয়ক জয়নাল আবেদীন মুকুল বলেন, দেশে মাথাপিছু চালের চাহিদার চেয়ে উৎপাদনে ঘাটতি নেই। মজুতদারদের কবল থেকে ধান-চাল উদ্ধার না করে আমদানির সিদ্ধান্ত ভুল। এতে ধানের বাজার পড়ে যাচ্ছে।

নওগাঁ জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান বলেন, “নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে।”

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক শামছুল ওয়াদুদ বলেন, এবারও আউশ ধানের ভালো ফলন হয়েছে। বাজারে দাম একটু কম হলেও কৃষকের লস হবে না। ধান কাটার পর সেসব জমিতে অধিক মূল্যবান সুগন্ধি (চিনি আতপ) জাতের ধান রোপণ করছেন কৃষকেরা। আউশ উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রমের প্রত্যাশা করছেন এই কৃষিবিদ।

গত বৃহস্পতিবার নওগাঁর সাপাহারে ওএমএস ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির কার্যক্রম পরিদর্শনের পর খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, জনগণকে স্বস্তি দিতে খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস) ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চালু করা হয়েছে।

ইতিমধ্যে কেজিপ্রতি চালের দাম ৫-৬ টাকা কমে গেছে। আউশ ধান পুরোদমে বাজারে উঠলে চালের দাম আরও কমবে। এতে করে অবৈধ মজুতদার ও অসাধু ব্যবসায়ীরা চরম শিক্ষা পাবেন বলে মনে করেন তিনি।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ