সম্পূরক খাদ্যে মাইকোটক্সিন : মাছ বা চিংড়ি চাষের নিরব ঝুঁকি লিখেছেন অমিতোষ সেন, প্রাক্তন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা, মৎস্য অধিদফতর। চিংড়ি বা মাছের খামারের সমস্যার কথা বললেই আমাদের প্রথমেই মনে আসে বিভিন্ন রোগজীবাণু যেমন পরজীবী, ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের সংক্রমণ, পানি ও মাটির গুণাবলীর সমস্যা ইত্যাদি। কিন্তু বাণিজ্যিক মৎস্য/চিংড়ি খামারে এইসব সমস্যা ছাড়াও আরো কিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা রয়েছে। এ ধরনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হল মাছ/চিংড়িকে যে সম্পূরক খাদ্য দেওয়া হয়, সেই খাদ্যে বিষাক্ত মাইকোটক্সিনের উপস্থিতি। এই সমস্যাটি অত্যন্ত নীরবে এবং চাষিদের চোখের আড়ালে থেকে খামারের চিংড়ি/মাছের মারাত্মক ক্ষতি করে যেতে থাকে।

সম্পূরক খাদ্যে মাইকোটক্সিন সৃষ্টি হয় খাদ্যে উপস্থিত মোল্ড বা ছত্রাক থেকে। খাদ্যে অন্তত তিন হাজার প্রজাতির ছত্রাক বংশ বিস্তার করতে পারে, যাদের মধ্যে অধিকাংশই খাদ্যে বিষাক্ত টক্সিন (মাইকোটক্সিন) তৈরি করে। মাছ/চিংড়ির খাদ্যে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে সক্ষম এরূপ প্রায় ৫০০ প্রকার মাইকোটক্সিন আছে। সম্পূরক খাদ্যের নিম্নমান, নিম্নমানের বা অপ্রয়োজনীয় বা ক্ষতিকর উপাদানের ব্যবহার, খাদ্যে বিভিন্ন উপাদান মিশ্রণের ক্ষতিকর পদ্ধতি, সঠিক পদ্ধতিতে খাদ্য সংরক্ষণ না করা, গুদামের খারাপ পরিবেশ, দীর্ঘদিনের পুরাতন খাদ্য ব্যবহার ইত্যাদি কারনে খাদ্যে ছত্রাক জন্মে সেখানে মাইকোটক্সিন তৈরি হতে পারে। এর পাশাপাশি, বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের জলবায়ু/আদ্রতা এবং তাপমাত্রা মাছ বা চিংড়ির খাদ্যে ছত্রাকের বংশ বৃদ্ধির পরিবেশ তৈরি করে মাইকোটক্সিন জনিত বিষাক্ততাকে অনেক গুণ বাড়িয়ে তোলে।

ফিশমিল বা ফিশ-অয়েলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে এসবের ব্যবহারে মৎস্য খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। এই কারনে ইদানিং মৎস্যখাদ্যে এসবের পরিবর্তে উদ্ভিজ্জ উৎসের আমিষ ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। এর মধ্যে আছে কর্ণ, সয়াবিনের খৈল, ক্যানোলা, তুলাবীজ, সীমজাতীয় ফলের বিচি, ধানের কুড়া, ভুট্টা ইত্যাদি। এসবের ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে মৎস্য খাদ্যে আমিষের মাত্রা বজায় রাখতে গিয়ে খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকানো যাচ্ছে বটে, কিন্তু মৎস্য খাদ্যে মাইকোটক্সিন তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রীতিমতো বেড়ে যাচ্ছে।

মৎস্য খাদ্যে বা খাদ্য উপাদানে সাধারন ভাবে পাঁচ ধরনের মাইকোটক্সিনের ক্ষতিকর প্রভাব দেখা যায়-

১। আফলাটক্সিন (Afla)।
২। জেরালিনন (ZEN)।
৩। ট্রাইকোটেসেনেস (T-2 এবং HT-2)।
৪। ফিউমোনিসিন (FUM)।
৫। অক্রাটকসিন (OTA)।

এবার দেখুন খাদ্যের এইসব মাইকোটক্সিন মাছ বা চিংড়ির খামারে কি কি ক্ষতি করতে পারে:

আফলাটক্সিন: মৎস্য/চিংড়ির জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর হল আফলাটক্সিন। এই টক্সিন মাছের লিভারে ঘা সৃষ্টি করে, যার ফলে মাছ মারা যায়। এছাড়াও আফলাটক্সিন মাছের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের কোষে ক্ষত, ফুলকায় ঘা, চিংড়ির হেপাটোপ্যানক্রিয়াসে ঘা ইত্যাদি মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করে। আফলাটক্সিন মাছের শরীরের রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়।

জেরালিনন:এই মাইকোটক্সিন মাছ ও চিংড়ির প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট করে দিতে পারে, ডিমের সংখ্যা কমে যেতে পারে বা ডিম ছাড়ার প্রবণতা কমে যেতে পারে।

ট্রাইকোটেসেনেস: এই মাইকোটক্সিনটির প্রভাবে মূলত মাছ বা চিংড়ির শরীরের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা দ্রুত কমে যায়। চিংড়ির শরীরে T-2 এবং HT-2 এর প্রভাবে এর বৃদ্ধির গতি কমে যায় এবং নানারকম শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হয়।

ফিউমোনিসিন:শরীরে এই মাইকোটক্সিনটির প্রভাবে মাছ বা চিংড়ির বৃদ্ধির গতি কমে যেতে পারে, খাদ্য গ্রহণের প্রবণতা বা বিপাকের গতি কমে যেতে পারে এবং বিভিন্ন ধরনের হরমোনের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে।

অক্রাটকসিন:মাছ বা চিংড়ির জিনগত বৈশিষ্ট্যের উপরেও এই মাইকোটক্সিনের ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। এছাড়া এর প্রভাবে কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে বা লিভারের সক্রিয়তা কমে যেতে পারে।

উপরে মাইকোটক্সিনের বিভিন্ন রকম ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা দেওয়া হলেও, সব ধরনের ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত ফলাফল কিন্তু উৎপাদন কমে যাওয়া এবং অপ্রত্যাশিত মৃত্যুহার, যার কোনটাই বাণিজ্যিক মৎস্য/চিংড়ি খামারের জন্য প্রত্যাশিত নয়। তাছাড়া এইসব মাইকোটক্সিন মাছ/চিংড়ির মাধ্যমে ভোক্তার শরীরে প্রবেশ করে মানুষেরও চরম শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
মৎস্যখাদ্যে মাইকোটক্সিন নিয়ন্ত্রণের জন্য “মৎস্যখাদ্য বিধিমালা, ২০১১” এবং “বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩” এ বিধিনিষেধ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের অন্যান্য ব্যবসার মতই বিবেকবোধ বা ধর্মীয় অনুভূতি যে মৎস্যখাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রেও নিষ্ক্রিয় নেই, তার তো কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই চাষিদের ফসলের সুরক্ষার জন্য তাদের নিজেদেরই সচেতন হতে হবে।

সাবধান হতে হবে চাষিদেরকেই:

মৎস্য চাষিদের দৃষ্টির আড়ালে মাইকোটক্সিনের কুপ্রভাব একটি বাস্তব এবং চিরন্তনী প্রক্রিয়া, যা একুয়াকালচার সেক্টরে দিন দিন বাড়ছে বই কমছেনা। সম্পূরক খাদ্যে মাইকোটক্সিনের উপস্থিতি চোখে দেখা যায়না, কোন গন্ধ হয়না, খাদ্যের রং বা স্বাদের পরিবর্তন হয়না। তাই মাছ বা চিংড়ির খামারে এই মাইকোটক্সিন একটি নিরব হুমকি।

সম্পূরক খাদ্যে মাইকোটক্সিনের কুপ্রভাব কমানোর জন্য খাদ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান, ডিলার, পাইকারি বা খুচরা বিক্রেতা এবং ব্যবহারকারী বা চাষি, সবারই ভূমিকা আছে। এর মধ্যে প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। কারন সম্পূরক খাদ্যে মাইকোটক্সিন তৈরির গোড়ার কারনটিই হল নিম্নমানের খাদ্য, নিম্নমানের বা অপ্রয়োজনীয় বা ক্ষতিকর উপাদানের ব্যবহার এবং খাদ্যে বিভিন্ন উপাদান মিশ্রণের ক্ষতিকর পদ্ধতি। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলি খাদ্যে মাইকোটক্সিনের প্রভাব কমানোর জন্য বিভিন্ন বাইন্ডার বা এবজর্ভার ব্যবহার করেন। কিন্তু দু এক ধরনের বাইন্ডার বা এবজর্ভার যেমন সব রকম মাইকোটক্সিন নিষ্ক্রিয় করতে পারেনা, তেমনি এসবের ব্যবহারে খাদ্যের দামও সামান্য বেড়ে যেতে পারে। এছাড়া কারখানায় উৎপাদীত খাদ্য দ্রুত বাজারজাত না করে গুদামে দীর্ঘদিন মজুদ করে রাখলেও এসব খাদ্যে মাইকোটক্সিনের ঝুঁকি বাড়তে থাকে।
কিন্তু কারখানার এইসব কর্মকান্ডের উপরে সাধারন চাষিদের কোন প্রকার নিয়ন্ত্রণমূলক ভূমিকা নেই। তাই সামান্য বেশি দাম হলেও এইক্ষেত্রে চাষিদের কোন প্রখ্যাত কোম্পানির খাদ্য ক্রয় করা উচিত।

সম্পূরক খাদ্যে মাইকোটক্সিনের প্রবণতা বৃদ্ধির পরবর্তী বড় কারন হল দীর্ঘদিন ধরে খাদ্য মজুদ করে রাখা, মজুদ করার আপত্তিকর/ভুল পদ্ধতি এবং গুদামের ক্ষতিকর পরিবেশ। এইক্ষেত্রে খাদ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান, ডিলার, পাইকারি বা খুচরা বিক্রেতা এবং ব্যবহারকারী বা চাষি, সবারই ভূমিকা সমান। এখানে চাষিদের খুব চালু ডিলার, পাইকার বা খুচরা আউলেট থেকে (যেখানে খাবার অবিক্রীত পড়ে থাকেনা) খাদ্য সংগ্রহ করতে হবে, খাদ্য কিনে বেশিদিন ফেলে না রেখে তাড়াতাড়ি ব্যবহার করে ফেলতে হবে, অতিরিক্ত খাবার একসাথে ক্রয় না করে কিছু কিছু করে ক্রয় করতে হবে, খাদ্যের মজুদ পদ্ধতি এবং পরিবেশ উন্নত করতে হবে, গুদামে পানি, স্যাতস্যাতে ভাব, সরাসরি বাতাস বা রৌদ্রের সাথে সংস্পর্শ, ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর চলাফেরা ইত্যাদি পরিহার করতে হবে, খাদ্য গুদামজাতকরণের নিয়ম মেনে চলতে হবে।

উপসংহার:
একুয়াকালচারে মাইকোটক্সিনের সমস্যা সারা বিশ্ব জুড়েই আছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টিকে অবহেলা করা হয়। চিংড়ি বা মৎস্য খামারে মাইকোটক্সিনের সার্বিক ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে তেমন পর্যাপ্ত গবেষণা নেই। কিন্তু এর ফলে যে মৎস্য/চিংড়ি সম্পদের প্রচুর ক্ষতি হতে পারে সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। মৎস্য খাদ্যে উদ্ভিজ্জ উৎসের উপাদান ব্যবহারের ক্রমবর্ধমান প্রবণতাই ইঙ্গিত করে যে, মৎস্য খাদ্যে মাইকোটক্সিনের ক্ষতিকর প্রভাব একসময়ে মৎস্য চাষিদের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারন হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই সাসটেইনেবল একুয়াকালচার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সময় থাকতেই বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সকলেরই চিন্তা করা উচিত। উদ্ভিজ্জ উৎসের উপাদান ব্যবহারের ক্রমবর্ধমান প্রবণতাই ইঙ্গিত করে যে, মৎস্য খাদ্যে মাইকোটক্সিনের ক্ষতিকর প্রভাব একসময়ে মৎস্য চাষিদের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারন হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই সাসটেইনেবল একুয়াকালচার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সময় থাকতেই বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সকলেরই চিন্তা করা উচিত।

সম্পূরক খাদ্যে মাইকোটক্সিন : মাছ বা চিংড়ি চাষের নিরব ঝুঁকি শিরোনামের লেখাটির লেখক অমিতোষ সেন, প্রাক্তন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা, মৎস্য অধিদফতর।

আরোও পড়ুন: বাগদা চিংড়ির রোগ: নেক্রোটাইজিং হেপাটোপ্যানক্রিয়াটাইটিস বা NHP