মৎস্য ডেস্ক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: বায়োফ্লক পদ্ধতিতে অল্প জায়গায় অধিক ঘনত্বে মাছ চাষ করা হয়। তাই এ পদ্ধতি অধিকতর লাভজনক হওয়ায় গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করেছে। আসুন জেনে নিই ১০ হাজার লিটার বায়োফ্লকে মাছ চাষে আয়-ব্যয় হিসাব-নিকাশ।

অনেকেই বাণিজ্যিকভাবে এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কেউ লাভবান হচ্ছেন, কেউবা পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। যেহেতু এই পদ্ধতিতে মাছ নিজের তৈরি বর্জ্য থেকে সৃষ্ট ফ্লক খায় এজন্যে এই পদ্ধতিতে খাবারের খরচ কম লাগে এবং পানির দূষণও কম হয়।

অনেকেই বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করার জন্যে এই বিষয়ের এক্সপার্টদের নিকট থেকে ট্রেনিং চান। বায়োফ্লক নিয়ে সাম্প্রতিককালে নানারকম আর্টিকেল, ইউটিউব ভিডিও পাওয়া যায়। সেখান থেকে অনেকেই বায়োফ্লক থেকে আয়-ব্যয়ের হিসেব ধারণা করার চেষ্টা করেন। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে অনেক হিসেব-নিকেশই অকার্যকর। এইজন্যে ১৬ মাস ধরে নওগাঁ জেলার একটি অঞ্চলে বায়োফ্লক প্রজেক্ট রিসার্চ থেকে প্রাপ্ত তথ্য আপনাদেরকে জানানোর চেষ্টা করব। বায়োফ্লক নিয়ে বিস্তারিত পড়তে পারেন।

১. একটি ১০,০০০ লিটারের বায়োফ্লক প্রজেক্ট থেকে কেমন আয়-ব্যয় হতে পারে, তার একটি ডিটেইল তথ্য আপনাদেরকে জানানোর চেষ্টা করব। ১০ ফিট বাই ১০ ফিটের একটি বায়োফ্লক প্রজেক্টে পানি ধারণ ক্ষমতা ১০,০০০ লিটার হয়ে থাকে। বায়োফ্লক প্রজেক্টের জন্যে আমরা দুইরকম খরচের হিসেব ধরতে পারি।

প্রথমত প্রাথমিক প্রজেক্ট সেট আপ খরচ:

এই খরচে আপনাদের ট্যাংক তৈরি করতে হবে ও কিছু যন্ত্রপাতি কিনতে হবে। ১০,০০০ লিটার প্রজেক্টের জন্যে সিমেন্টের ট্যাংক কিবা তারপলিনের ট্যাংক ব্যবহার করতে পারেন। সিমেন্টের ট্যাংক করলে ২২,০০০ টাকা খরচ পড়বে। তারপলিনের ট্যাংকে খরচ একটু বাড়বে। সেক্ষেত্রে ৩০০০০ এর মত পড়বে।

২. বায়োফ্লকের জন্যে আপনাকে বাতাস দেওয়ার জন্যে aerator ও কিছু জিনিস কিনতে হবে। এটি ৫০০০-৭০০০ এর মধ্যে পাবেন। অনেকে প্রজেক্টের দেখাশোনার জন্যে লোক রাখতে পারেন। সেক্ষেত্রে প্রতি মাসে ৫০০০ করে ধরলে একটি হার্ভেস্ট পাওয়া পর্যন্ত চার মাস ধরে দেখাশোনার লোক রাখতে হবে। সেইক্ষেত্রে ২০,০০০ টাকা খরচ করতে হবে। ১০,০০০ লিটার প্রজেক্টের জন্যে প্রাথমিক খরচ প্রায় ৪৯,০০০ থেকে ৫৬,০০০ টাকার মতো পড়তে পারে।

৩. এবার আমরা কিছু খরচ দেখাবো, যেগুলো প্রতিটি হার্ভেস্টের জন্যে লাগবে। একটি প্রজেক্টের জন্যে কিছু উপাদান কিনতে আপনাকে ব্যয় করতে হবে।

৪. ১০,০০০ লিটার প্রজেক্টের জন্যে প্রথমেই যে জিনিসটি লাগবে, তা হল ৫০০ গ্রাম প্রোবায়োটিক। বাজারে বিভিন্ন ব্রান্ডের প্রোবায়োটিক পাওয়া যায়। একেক ব্রান্ডের প্রোবায়োটিকের দাম একেকরকম। এভারফ্রেশ প্রো প্রোবায়োটিক ব্যবহার করলে ৫০০ গ্রামের জন্যে খরচ হবে ১৫০০ টাকা।

৫. এরপর আপনার লাগবে মোলাসেস। এই প্রজেক্টের জন্যে আনুমানিক ৬ কেজি মোলাসেস প্রয়োজন হবে। ৩৫ টাকা কেজি দরে মোলাসেসের দাম পড়বে ২১০ টাকা। যেকোনো মোলাসেস ব্যবহার করলেই হবে। ভাল মানের মোলাসেস কিনতে গিয়ে খরচ বাড়ানোর প্রয়োজন নেই।

৬. এরপর লাগবে ১ কেজি ক্যালসিয়াম কার্বনেট বা ডলোমাইট চুন। যেটি পাবেন ৫০ টাকায়। ১২ কেজি আয়োডিনমুক্ত মোটা দানাদার লবনের জন্যে খরচ করতে হবে ১৫০ টাকা। মাছের পোনা নিতে গেলে অবশ্যই খেয়াল করতে হবে কি জাতের পোনা নিচ্ছেন, কি সাইজের পোনা নিচ্ছেন।

৭. ভাল জাতের ৫০০-৮০০ পিস/কেজি শিং মাছের পোনা লাগবে ৬০০০ পিসের মত। এক্ষেত্রে মাছের পোনার বিভিন্নরকম সাইজ হতে পারে। কিছু পোনা মারাও যেতে পারে। তাই একটু বেশিই নেওয়া লাগবে। এর দাম পড়বে প্রায় ১২০০০ টাকা। ভাল জাতের পোনার জন্যে যোগাযোগ করুন।

৮. এরপর যে জিনিসটি লাগবে, তা হল মাছের ফিড। ৬০০০ পিস মাছের জন্যে ৪ মাসে প্রায় ২০০-২৫০ কেজি ফিড প্রয়োজন। এই ফিডের জন্যে খরচ করতে হবে ২০০০০ টাকা। এটাই মূলত প্রধান খরচের খাত। এছাড়া চার মাসে এসইও ০০৬ কিংবা এসইও ০০৮ মোটরগুলো সারা রাত ব্যবহার করলে খরচ পড়বে ১২০০ টাকা। কিছু আণুষাঙ্গিক খরচ বাড়তে পারে। এই অতিরিক্ত খরচ ধরেছি ১০০০ টাকার মত। সর্বমোট এই খাতে খরচ করতে হবে ৩৬,১১০ টাকা।

৯. এতোক্ষণ দেখালাম খরচের খাতসমূহ। এবার আসুন দেখি এই প্রজেক্ট থেকে কত উপার্জন হবে। অনেকেই বলে থাকেন ১০,০০০ লিটার প্রজেক্ট থেকে ৮০০-১০০০ কেজি মাছ পাওয়া সম্ভব।

১০. বায়োফ্লক প্রজেক্টে অল্প ঘনত্বে অধিক মাছ চাষ করা গেলেও, এত মাছ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এখনো সম্ভব নয়। তেলাপিয়া মাছ ভালোভাবে চাষ করলে ৩০০-৩৫০ কেজি উৎপাদন সম্ভব। শিং মাছের ক্ষেত্রে উৎপাদন একটু কম।

১১. ২৫০-৩০০ কেজির মত। একেকরকম মাছে একেকরকম উৎপাদন হবে। তবে আমরা ধরে নিলাম গড়ে ৩০০ কেজি মাছ উৎপাদিত হবে। খুব ভালোভাবে চেষ্টা করলে এটি অসম্ভব নয়।

১২. ক্যাটফিশ জাতীয় মাছ প্রতি কেজি অনায়াসেই ৩০০-৪০০ টাকায় বিক্রি করতে পারবেন। তেলাপিয়ার ক্ষেত্রে ১৫০-২০০ টাকা কেজি। কই মাছ ১৮০ টাকা আর পাঙ্গাসের ক্ষেত্রে ১০০-১২০ টাকা কেজি। ক্যাটফিশ জাতীয় মাছ লাভজনক হলেও, এর উৎপাদনে অধিক যত্নশীল হতে হয়। কেননা এই জাতীয় মাছের রোগের প্রাদুর্ভাবও বেশি।

১৩. আমাদের উৎপাদিত ৩০০ কেজি মাছ ৩০০ টাকা দরে বিক্রি করলে অনায়াসে ৯০,০০০ টাকা আয় করা সম্ভব। এক্ষেত্রে যদি আমরা আমাদের খরচের হিসেব দেখি আমাদের প্রাথমিক খরচ ছিল ৪৯০০০-৫৬০০০ টাকা। আর এক হার্ভেস্টের খরচ ছিল ৩৬১১০ টাকা।

১৪. সর্বমোট খরচ হয় ৮৫১১০ – ৯২১১০ তাকার মত। আমরা রেঞ্জ করে দেখাচ্ছি কেননা কেউ হয়ত তারপলিন দিয়ে ট্যাংক করবেন, কেউবা সিমেন্ট দিয়ে। দুইক্ষেত্রে দুইরকম খরচ হতে পারে। আমাদের প্রথম হার্ভেস্টে আয় ছিল ৯০,০০০ টাকা।

অর্থাৎ প্রথম হার্ভেস্টে আপনি সামান্য কিছু লাভও করতে পারেন, অথবা নাও পারেন। এক্ষেত্রে আপনি যদি নিজেই প্রজেক্ট ম্যানেজ করেন, তবে ম্যানেজমেন্ট এর জন্যে আলাদা করে ৪ মাসের জন্যে ২০০০০ টাকা খরচ করতে হবে না। আপনি প্রথম প্রজেক্টেই লাভবান হতে পারবেন।

পরবর্তী হার্ভেস্টে আপনার প্রাথমিক খরচগুলো করার প্রয়োজন হবে না।  তখন আপনার খরচ হবে ৩৬১১০ টাকা।
দ্বিতীয় হার্ভেস্টে আপনি ১০,০০০ লিটার প্রজেক্ট থেকে ৫৩,৮৯০ টাকা লাভ করতে পারবেন।

উপরের পুরো হিসেবটি স্থান, কাল ভেদে কিছুটা বাড়তি-কমতি হতে পারে। মাছের পোনার দাম বিভিন্ন সময় বাড়তে বা কমতে পারে। বা মাছের দামও পরিবর্তিত হতে পারে।

তবে খুব একটা পার্থক্য হবে না। সঠিকভাবে প্রজেক্ট শুরু করতে পারলে বায়োফ্লক প্রজেক্টেই আপনি লাভবান হতে পারবেন।

১০ হাজার লিটার বায়োফ্লকে মাছ চাষে আয়-ব্যয় হিসাব-নিকাশ সংবাদের তথ্য বায়োফ্লফ থেকে নেওয়া হয়েছে।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ