মেহেদী হাসান, নওগাঁ থেকে ফিরে, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: শেয়ারে ডিমপাড়া মুরগির খামার করেছিলেন গুলবর রহমান ও আব্দুর রাজ্জাক। তাদের দেখাদেখি একটির পর একটি খামার গড়ে উঠতে থাকে এলাকায়। কেউ করেছেন মাংসের জন্য ব্রয়লার মুরগির খামার, কেউবা হাঁসের খামার আবার কেউ সোনালি মুরগির খামার। এখন এলাকায় ১০ থেকে ১৫ টি খামার গড়ে উঠেছে।

উপজেলায় নিবন্ধিত এবং অনিবন্ধিত গরু, লেয়ার মুরগি, ব্রয়লার মুরগির ৩’শ ৩৭ টি খামার রয়েছে বলে জানান উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা।

গ্রামীন ব্যাংক থেকে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়ে দুইটি গরু কিনেছিলেন। এরপর নিজের জমানো ও ধারের টাকায় মুরগির খামার শুরু করেন গৃহবধূ মোছাঃ কাজল রেখা। কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। প্রথমে মুরগি মারা গিয়ে প্রায় দেড় লাখ টাকা লোকসান গুণতে হয় তাকে। তবে পরিশ্রম আর মনোবল দৃঢ় করে নিজের আত্মবিশ্বাসের ওপর ভর করে সব পাল্টে দিলেন তিনি। মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় অভাব দুর করে স্বাবলম্বী হলেন তিনি। কিন্তু কীভাবে নিজের পায়ে দাঁড়ালেন?

স্বামী সাইদুর রহমান মুদি দোকানদার। কাজে বেশিরভাগ সময় থাকেন বাইরে। সংসারে সচ্ছলতা তেমন একটা নেই। দুই সন্তানের খরচের জেরে সংসারে টানাটানির অবসান কোনমতেই যায় না। ভাবলেন নিজেই কিছু একটা করা দরকার। গ্রামীন ব্যাংক থেকে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়ে দুইটি গরু কিনলেন। এরপর ২ বছরের মধ্যে ঋণের টাকা শোধ করে স্বামীর সহযোগিতায় মুরগির খামার শুরু। পাঁচশ লেয়ার মুরগি কিনে খামার শুরু করতেই রাণীক্ষেত রোগে দুই’শ বিশটি মুরগি মারা যায়। দমে গেলেন না তিনি। বাঁকি মুরগি থেকে লাভের মুখ দেখায় আবারো মুরগি কিনেছেন রেখা। এখন চারটি গুরু এবং পাঁচশ মুরগি রয়েছে তার বাড়িতে। পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি হয়েছেন লাখোপতি। এই সফলতার গল্প নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার। উপজেলার ১১ নংকালিকাপুর ইউনিয়নের চকরঘুনাথ গ্রামে তার বাড়ি।

আরোও পড়ুন: পাইকারশূন্য স্থানীয় বাজার, ক্ষেতেই পচে যাচ্ছে সবজি!

কাজলের সাফল্যের কথা আশপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রামে যারা বাড়িতে বেশি হাঁস- মুরগি পালন করেন তারাও আসেন বিভিন্ন পরামর্শ নিতে। তাঁদের স্বচ্ছল হওয়ার পথ বাতলে দিচ্ছেন তিনি। গত ১৫ এপ্রিল রেখার খামার দেখতে চকরঘুনাথ গ্রামে গেলে কথা হয় তাঁর সঙ্গে।

রেখা জানান, স্বামী সাইদুর রহমান কৃষিকাজের পাশাপাশি মুদিখানার ব্যবসা করেন। সেখান থেকে যা আয় হয় তা দৃই ছেলের পড়াশুনার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয়। সেই টাকায় সংসার ঠিকমতো চলে না।

দুই ছেলের পড়াশুনার খরচ চালাতে টানাটানিতে পড়ে নাভিশ্বাস উঠে যায়। অনেক ভেবে চিন্তে একটি মুরগির খামার করার চিন্তা করলেন। দুই লাখ টাকায় বাড়ির সামনের ফাঁকা জমিতে শুরু করেন লেয়ার মুরগির খামার। এর মধ্যে স্বামীর সহযোগিতায় খুব একটা বেগ পেতে হয়নি তাকে। টানা পাঁচ মাস দিন-রাত পরিশ্রম করার পর শুরু হয় ডিম উৎপাদন। সময়টা ২০১৮ সালের শেষের দিকে।

গরু এবং মুরগি থেকে রেখার আয় মাসে প্রায় ২০ হাজার টাকা। রেখার ৫ কাঠা আয়তনের খামারে এখন বিনিয়োগ ৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকঋণ ১ লাখ টাকা। লাভের টাকা ছেলেদের পড়াশুনার জন্য মাসে মাসে খরচ করতে হয়। আর এ খরচের ভারেই তার খামার আর বড় হয়ে উঠে না।

রেখা বলেন, ‘আমি খামার করা শুরু করি, মানুুষের দেখাদেখি। তখন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। আর আমি খামারে প্রচুর সময় দিয়ে পরিচর্যা করি। পরিশ্রমের ফল হাতে হাতে পেয়েছি। খামার বড় করতে পারিনি তার বড় কারণ আমার মাসে মাসে প্রচুর টাকা খরচ করতে হয়। প্রথমবারে মুরগি মারা যাওয়ায় চিন্তায় পড়েছিলাম কিন্তু আশা ছাড়িনি। ব্যবসাতে লাভ লোকসান তো দু-ভাই ’

এর মধ্যে ছেলেরা বড় হয়েছে। বড় ছেলে সোহাগ হোসেন বিএসসিতে পড়ছেন রাজশাহী কলেজে। ছোট ছেলে আব্দুল বাকির সজীব পড়ছেন রাজশাহী মডেল স্কুল এণ্ড কলেজে একাদশ শ্রেণিতে।

আব্দুল বাকির সজীব এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, ‘লেখাপড়ার পাশাপাশি বাকি সময়ে আম্মুকে সহযোগিতা করেছি। এখন আমি রাজশাহীতে চলে যাওয়ায় সবকিছু আম্মুকে এক সামলাতে হয়অ করোনার কারনে বাড়িতে এসেছি। এখন আম্মুকে সহযোগিতা করছি।’

একই গ্রামের আরেক নারী রোজিনা আকতার বলেন,‘ রেখা আপা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। তাঁর দেখাদেখি এক বছর আগে আমি একটি মুরগির খামার গড়ে তুলি। আমার খামারেও ৫০০ লেয়ার মুরগি ছিল। কিছুদিন আগে বিক্রি করে দিয়েছি। অনেক টাকা লাভ করেছি ’

রেখা বলেন, ‘ গ্রামীন ব্যাংক থেকে ঋণ খুব সহযেই পাওয়া যায়। প্রশিক্ষণের অভাবে গ্রামের নারীরা এগিয়ে যেতে পারছেন না। প্রশিক্ষণ এবং ঋণসুবিধা পেলে গ্রামের বহু বেকার ও শিক্ষিত নারী এই পেশায় স্বাবলম্বী হতে পারেন। আমি এ ব্যাপারে নারীদের উৎসাহ দিচ্ছি। যারা এ বিষয়ে জানতে চায় তাদের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকি। আমি চাই, আমার মতো আশপাশের অন্য মেয়েরাও এগিয়ে আসুক। ’

আরোও পড়ুন: স্বেচ্ছাশ্রমে ধান কেটে দিচ্ছেন কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীরা

কালিকাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল আলিম এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন,‘ কাজল রেখা’র দুই ছেলে রাজশাহীতে পড়াশুনা করে। মুরগির খামার করে বেশ স্বাবলম্বী এখন। ইউনিয়নে এরকম অনেক নারী রয়েছে যারা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়েছেন’

মান্দা উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ অভিমান্য চন্দ্র এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন,‘ উপজেলায় নিবন্ধিত ৩৯ টি এবং অনিবন্ধিত ১২১ টি গরুর খামার ; লেয়ার মুরগির নিবন্ধিত ২২ টি এবং অনিবন্ধিত ১০টি খামার; ব্রয়লার মুরগির নিবন্ধিত ৯১ টি এবং অনিবন্ধিত খামার রয়েছে ৫৪টি। এসব খামারিদের পাশে থেকে সাহস দেওয়া হচ্ছে যাতে তারা এ পরিস্থিতিতে ভেঙ্গে না পড়েন। কোন খামারে সমস্যা হলে আমরা উপস্থিত হই এবং নানা পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করছি।’