ড. বাহাউদ্দিন আহমেদ, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: বাংলাদেশে বেগুন ও টমেটো অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রধান দুটি সবজি। বাংলাদেশ এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বেগুন ও টমেটো চাষের জন্য প্রধান সমস্যা হলো মাটিবাহিত বিভিন্ন রোগ। এই রোগের কারণে ফলন বিপর্যয় হয়ে ফলন অর্ধেকে নেমে আসে। কিন্ত রোগ বালাই নিয়ন্ত্রণ করে এক টেকনিকেই টমেটোর ফলন হবে দ্বিগুণ! এমন এক বিষয় নিয়েই আজকের আলোচনা।

প্রধানত ঢলেপড়া রোগ ও শিকড়ের গিট রোগ টমেটো ও বেগুন চাষে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। উচ্চ তাপমাত্রা ও মাটিতে বেশি আর্দ্রতা থাকলে এই দুটি রোগ দ্রæত বিস্তার লাভ করে। এ দুটি রোগের কারণে বেগুন ও টমেটোর ফলন ৩০-৫০ ভাগ বা তার বেশি কমে যায়। বাংলাদেশ বা অন্য কোন দেশে রাসায়নিক বিষ বা অন্য কোন দমন পদ্ধতির মাধ্যমে এ রোগ দুটি সন্তোষজনকভাবে দমন করা এখনো সম্ভব হয়নি। ব্যাপক হারে মাটি শোধন বা মাটি জীবাণুমুক্ত করা প্রায় অসম্ভব। এ ছাড়া এ পদ্ধতি মাটির বিভিন্ন উপকারী জীবাণু ধ্বংস করে।

দুটি জংলি বেগুনের প্রজাতি বাংলাদেশের সব জায়গায় জন্মায়। এসব জংলি বেগুন গাছের উপর কলমের মাধ্যমে বেগুন ও টমেটো গাছ তৈরি করে মাটি বাহিত বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা করে উচ্চফলন নিশ্চিত করা যায়। এই পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে বেগুন ও আগাম টমেটো চাষে ব্যাপক সাফল্য বয়ে আনবে, আমাদের সবজি চাহিদা মিটানো যাবে এবং কৃষকেরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।

এগ্রিকেয়ার২৪.কমের আরোও নিউজ পড়তে পারেন:

গ্রীষ্মকালীন টমেটো বারি-৮ চাষে ভাগ্য বদলাচ্ছে কৃষকের

ভারতীয় এলাচের কেজিতে কমলো ২০০ টাকা

অপ্রধান মসলা ধনিয়া চাষে ধনী ময়েজ

জোড়কলমের মাধ্যমে বেগুন ও টমেটো চাষ করলে ৯০%-৯৫% গাছ ঢলেপড়া রোগ এবং শিকড় গিট রোগ থেকে রক্ষা পায়। বেগুন ও আগাম টমেটো চাষে এই রোগ ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। তাই আগাম টমেটো ও বেগুন চাষের জন্য জোড়কলম পদ্ধতি অত্যন্ত উপযোগী ও লাভজনক।

জংলী বেগুনের শিকড় সুস্থ ও সবল হওয়ায় মাটি থেকে সঠিক পরিমাণে খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করতে পারে, ফলশ্রæতিতে ফলন অনেক বেশি হয় এবং এক থেকে দেড় মাস বেশি ফলন দিয়ে থাকে। পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, জোড়কলম পদ্ধতিতে বেগুন ও টমেটোর চাষ করলে ১.৫-২ গুণ বেশি ফলন পাওয়া যায়।

জোড়কলম প্রযুক্তি সর্ব প্রথম জাপানি বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেন এবং জংলী বেগুনের সাথে আবাদি বেগুন বা টমেটোর জোড়কলমের মাধ্যমে মাটিবাহিত রোগ দমনে সফলতা পান। ১৯৩০ সালে জাপানে শতকরা ৯৫ ভাগ বেগুন চাষি কলমকৃত বেগুন গাছ রোপণ করেন।

আসুন জেনে নিই যেভাবে জোড়কলম করবেন:

যে গাছের ওপর কলম করা হয় তাকে ‘আদি জোড়’ বলে। আর যে গাছকে কলমের জন্য ব্যবহার করা হয় তাকে উপজোড় বলে। জোড়কলম করার জন্য প্রথমে আদি জোড় হিসাবে কাঁটা বেগুনের বীজ বীজতলায় ফেলতে হবে। কাঁটা বেগুনের ২-৩টি পাতা বের হলে এ চারা ১৮ সেমি.ী১৩ সেমি. আকারের মাটি ভর্তি পলিথিন ব্যাগে স্থানান্তর করতে হবে।

বেশি বয়সের চারা পলিথিন ব্যাগে স্থানান্তর করলে কলম তৈরির জন্য উপযোগী হবে না। পলিথিন ব্যাগে অর্ধেক পচা গোবর ও অর্ধেক ভিটে বালুর মিশ্রণ থাকবে। টমেটো ও বেগুনের চারায় নিয়মিত পানি দিতে হবে যাতে চারা সুস্থ ও সবল থাকে। কাঁটা বেগুনের বীজ ফেলার ৭-১০ দিন পর উপ-জোড়ের জন্য আবাদি বেগুন বা টমেটোর বীজ ফেলতে হবে। কাটা বেগুনের চারা ৪০-৫০ দিন এবং বেগুনের চারা ও টমেটোর চারা ৩০-৩৫ দিন হলে জোড়কলম করার উপযুক্ত হয়।

এগ্রিকেয়ার২৪.কমের আরোও নিউজ পড়তে পারেন:

এক গাছে ১২৬৯ টমেটো!

টমেটোর পাতায় জিংক ও বোরন প্রয়োগে ফলন দ্বিগুণ

৭৫ শতাংশ জমিতে ৫ লাখ টাকার টমেটো বিক্রির আশা আলীমের

কলম করা উপযোগী টমেটো বা বেগুনের চারা বীজতলা থেকে উঠিয়ে শিকড়ের মাটি ধুয়ে কিছুটা পানিসহ একটি পাত্রে শিকড় ডুবিয়ে রাখতে হবে যাতে চারাগুলো শুকিয়ে না যায়। জংলী বেগুনের চারার ব্যাগগুলো এনে একটি ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে এরপর, পলিথিন ব্যাগের জংলী বেগুনের চারার গোড়া থেকে ৫-৬.৫ সেমি. (২ ইঞ্চি-২.৫ ইঞ্চি) কাÐ রেখে উপরের অংশ কেটে ফেলে দিতে হবে।

কাÐের কাটা মাথাকে বেøডের অর্ধেক পরিমাণ ঢুকিয়ে প্রায় ১ সেমি. গভীর করে ২ ভাগে লম্বালম্বি কাটতে হবে। এরপর টমেটো বা বেগুনের চারার মাথার উপরের অংশের প্রায় ৫ সেমি. কেটে বড় পাতা ফেলে দিতে হবে কাটা অংশের নিচে দুই পাশ থেকে প্রায় ১ সেমি. লম্বা “ঠ” অক্ষরের মতো কাটতে হয়। এবার টমেটো বা বেগুনের “ঠ” এর ন্যায় মাথাটি (উপজোড়) জংলী বেগুন চারার কাটা স্থানে (আদি জোড়) ঢুকিয়ে দিতে।

পরবর্তীতে প্লাস্টিক ক্লিপ দিয়ে জোড়াটি ভালোভাবে আটকে দিতে হবে এবং গাছের উপরের অংশে ছোট হাত স্প্রে মেশিন দিয়ে পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। জোড়ার স্থানে যেন পানি না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কলম করার কাজ বিকাল বেলা করাই ভালো। জোড়কলম করার পর কী কী পরিচর্যা করা দরকার।

কলম করা বেগুন বা টমেটো গাছ বাঁশের তৈরি ছই-এর মতো একটি গ্রাফটিং হাউজে বা ঘরে রেখে পলিথিন ও চট বা কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এতে ঘরের ভেতরে প্রচুর আর্দ্রতা বজায় থাকবে এবং সূর্যের আলো সরাসরি লাগবে না, যা কলমের জোড়া লাগাতে সাহায্য করবে। কলম করার পর ৭ দিন পর্যন্ত প্রতি দিন ৪-৫ বার স্প্রে মেশিন দিয়ে কুয়াশার ন্যায় পানি ছিটাতে হবে।

এগ্রিকেয়ার২৪.কমের আরোও নিউজ পড়তে পারেন:

ইতালিয়ান টমেটো চাষে তাক লাগিয়েছেন মাসুদ

টমেটো চাষে সারের পরিমাণ ও পরিচর্যা

৩ বিঘায় ৩ লাখ টাকার টমেটো বিক্রি

বৃষ্টি না হলে রাতে ঘরের আচ্ছাদন খুলে দিতে হবে, তাতে রাতের কুয়াশায় গাছ সতেজ থাকবে। দিনের বেলায় ঘর ঢেকে রাখতে হবে নতুবা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে উপজোড় শুকিয়ে যাবে। এক সপ্তাহ পর পলিথিন সরিয়ে শুধু চট বা কালো কাপড় দিয়ে ১ সপ্তাহ ঢেকে রাখতে হবে।

এ সময়ে প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে আচ্ছাদন খুলে দিতে হবে এবং প্রখর রোদের সময় তা ঢেকে রাখতে হবে। কলম করার ১৫-২০ দিন পর গাছ মাঠে লাগানোর উপযুক্ত হয়। মাঠে কলমের চারা লাগানোর ৭-১০ দিন পর জংলী বেগুনের গাছের গজানো ডালপালা কেটে ফেলতে হবে। চারা মাঠে লাগানোর কয়েক দিন পরে ক্লিপ খুলে নিতে হবে। একজন লোক দৈনিক ৪০০-৫০০টি জোড়কলম তৈরি করতে পারেন। উপযুক্ত পরিচর্যা করলে শতকরা ৯৫ ভাগ জোড়কলম টিকে থাকে।

ঢলেপড়া রোগ আগাম টমেটো ও বেগুন চাষে একটি বিরাট অন্তরায়। তাই জোড় কলম পদ্ধতি আগাম টমেটো এবং বেগুন চাষে একটি লাভজনক প্রযুক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এছাড়া বেগুনের অন্যান্য মাটিবাহিত রোগও এ প্রযুক্তির মাধ্যমে অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব এবং আগাম ও দীর্ঘদিন ধরে ফলনের জন্য কৃষকেরা ব্যাপকভাবে লাভবান হবেন।

এই পদ্ধতি নার্সারি ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যবসার উপকরণ হতে পারে এবং বাণিজ্যিকভাবে এই কলাকৌশলের বিস্তার ঘটানো সম্ভব এবং সফলভাবে মাটিবাহিত রোগজীবাণু দমন করা সম্ভব।

এক টেকনিকেই টমেটোর ফলন হবে দ্বিগুণ লেখাটি লিখেছেন ড. বাহাউদ্দিন আহমেদ ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সবজি বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বারি, জয়দেবপুর, গাজীপুর।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ