ফসল ডেস্ক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: টমেটো চাষে জামালপুর সদর উপজেলার পূর্বাঞ্চলের ৫টি ইউনিয়নের ৩৭টি গ্রামের ৬ হাজার কৃষক লাভবান হয়েছেন। তেমনই এক চাষি শফিকুল ইসলাম। চলতি মৌসুমে যিনি ৩ বিঘায় ৩ লাখ টাকার টমেটো বিক্রি করেছেন।

জামালপুর সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, উপজেলার লক্ষ্মীরচর, তুলসীরচর, রানাগাছা, শরিফপুর ও নরুন্দি ইউনিয়নের ৩৭টি গ্রামের প্রায় ৬ হাজার কৃষক ব্রহ্মপুত্র নদের তীরের চরগুলোতে ১ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে টমেটো চাষ করেছেন।

পড়তে পারেন: রাতের অন্ধকারে ফলন্ত ৫০০ টমেটো গাছ কাটলো দুর্বৃত্তরা

লক্ষ্মীরচর ইউনিয়নের চর যথার্থপুর গ্রামের টমেটো চাষি মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, তিন বিঘা জমিতে এবার টমেটো চাষ করেছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলন ভালো হয়েছে। সবকিছু মিলে তাঁর প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে তিনি টমেটো বিক্রি শুরু করেছেন। এ পর্যন্ত তিনি তিন লাখ টাকার টমেটো বিক্রি করেছেন। তাঁর খেতে আরও ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার টমেটো আছে। টমেটো চাষ করে তাঁর পরিবারে সচ্ছলতা ফিরেছে।

জামালপুর সদর উপজেলার পূর্বাঞ্চলের গ্রামগুলোতে টমেটোর বাম্পার ফলন হয়েছে এবার। বাজারে দামও মিলছে ভালো। ফলে কৃষকের মুখের হাসি আরও চওড়া হয়েছে। টমেটো চাষ করে ওইসব গ্রামের প্রায় ছয় হাজার কৃষক আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। কৃষক ও ব্যবসায়ীদের তথ্যানুসারে, চলতি মৌসুমে এ পর্যন্ত প্রায় ২০০ কোটি টাকার টমেটো বিক্রি হয়েছে। তবে হিমাগার থাকলে আরও বেশি টাকায় টমেটো বিক্রি করা সম্ভব হতো বলে জানান কৃষকেরা।

পড়তে পারেন: পৌষ মাসে চাষ করতে পারেন যেসব শাক-সবজি

জামালপুরে টমেটোর সবচেয়ে বড় বাজার নান্দিনা। সম্প্রতি দেখা যায়, নান্দিনা বাজারে বিশাল মাঠজুড়ে শুধু টমেটো আর টমেটো। শতাধিক নারী ও পুরুষ শ্রমিক বিক্রির জন্য টমেটো স্তূপ করে রাখছেন। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারেরা।

টমেটোর ট্রাক বোঝাই করতে ব্যস্ত। মৌসুমে নান্দিনা বাজার থেকে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ হাজার মণ টমেটো ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। মৌসুমের প্রথম দিকে দুই থেকে তিন হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হয়েছে টমেটো। শেষ দিকে তা ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় নেমে এসেছে।

পড়তে পারেন: বাংলাদেশে চাষ হচ্ছে ‘অর্নামেন্টাল ফ্রুট’

জামালপুর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দিলরুবা ইয়াছমিন বলেন, সদর উপজেলার পূর্বাঞ্চলে ব্রহ্মপুত্রের বিস্তীর্ণ চরে টমেটো এখন টেকসই ফসল হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। টমেটো চাষ করে কৃষকেরা ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। তাঁদের চাষ করা টমেটো এখন প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্তে চলে যাচ্ছে। গত ডিসেম্বর থেকে টমেটো বিক্রি শুরু হয়েছে, চলবে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত। প্রতি বিঘায় একজন চাষি খরচ বাদে এ বছর ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা মুনাফা করতে পারবেন বলে জানান তিনি।

টমেটোর ৪ ধরণের রোগবালাই ও দমন ব্যবস্থাপনা

কৃষিবিদ সমীরণ বিশ্বাস, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: অন্যান্য ফসলের মতো টমেটোও বিভিন্ন রোগবালাই দ্বারা আক্রান্ত হয়। রোগের কারণে ব্যাপক ফলন হ্রাস পায় এবং চাষিরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। আজ আমরা টমেটোর ৪ ধরণের রোগবালাই ও দমন ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানব:-

বাংলাদেশে টমেটো ফসলে যেসব রোগ দেখা যায়, আলোচনার সুবিধার্থে আমরা সেসব রোগবালাই মোটামুটি চার ভাগে ভাগ করতে পারি-

১. ছত্রাকজনিত রোগ যেমন- নাবি ধ্বসা, আগাম ধ্বসা ও ঢলে পড়া।
২. ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ যেমন- ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট বা নেতিয়ে পড়া।
৩. ভাইরাসজনিত রোগ যেমন- মোজাইক ও পাতা কোঁকড়ানো।
৪. নেমাটোডজনিত রোগ যেমন- শিকড়ের গিঁট ইত্যাদি।

পড়তে পারেন: রাজশাহীতে বিষাক্ত ইথিফন দিয়ে পাকানো হচ্ছে টমেটো

নাবি ধ্বসা রোগ :
এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ। গাছের আক্রান্ত অংশ, বীজ, মাটি ও পানি দ্বারা এ রোগ বিস্তার লাভ করে। এ রোগের আক্রমণে টমেটো গাছের পাতায় বিভিন্ন আকারের ভেজা বাদামি বর্ণের দাগ পড়ে। দাগগুলো তাড়াতাড়ি বাড়তে থাকে। পাতা পচে যায়। শুষ্ক ও আর্দ্র আবহাওয়ায় পাতার পচন দ্রুত বিস্তার লাভ করে। কয়েক দিনের মধ্যে গাছ মারা যায়। টমেটো ফল আক্রান্ত হলে তাতে ধূসর বর্ণের দাগ পড়ে। ৯১ থেকে ১০০ ভাগ আপেক্ষিক আর্দ্রতা ও ১২ থেকে ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এ রোগের ছত্রাক দ্রুত বিস্তার লাভ করে।

দমন ব্যবস্থাপনা :
১. ফসলের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
২. নীরোগ বীজ ব্যবহার করতে হবে।
৩. শস্য পর্যায় অনুসরণ করতে হবে।
৪. রোগের লক্ষণ দেখার সঙ্গে সঙ্গে একরোবেট এমজেড (ম্যানকোজেব+ডাইমেথোমরফ) ০৪গ্রাম/লিটার বা হেডলাইন টিম (পাইরাক্লস্ট্রাবিন+ডাইমেথোমরফ) ২.৫০গ্রাম/লিটার বা হেমেনকোজেব বা রিডোমিল গোল্ড বা ইন্ডোফিল এম-৪৫ বা ডায়থেন এম-৪৫ প্রভৃতি ০৪গ্রাম/লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে ৭ থেকে ১০ দিন অন্তর ¯েপ্র করতে হবে।

রোগের প্রকোপ বেশি হলে উপরের ছত্রাকনাশকগুলোর সাথে কার্বেন্ডাজিম যেমন- ডিফেন্স ৩৫এসসি বা নোইন বা অটোস্টিন প্রভৃতি মিশাতে হবে।

পড়তে পারেন: রাজশাহীতে বিষাক্ত ইথিফন দিয়ে পাকানো হচ্ছে টমেটো

আগাম ধ্বসা রোগ :
এটিও একটি ছত্রাকজনিত রোগ। গাছের আক্রান্ত অংশ ও বীজের মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। অত্যধিক শিশির, ঘনঘন বৃষ্টি এবং ২৩ থেকে ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। এ রোগের আক্রমণে পুরনো পাতায় বাদামি বা ধূসর বাদামি বর্ণের গোল চক্রাকার দাগ পড়ে। পরে অন্য পাতায় এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। পাতার কিনারা বিবর্ণ হয়ে যায় এবং কিছুদিনের মধ্যে পাতা ও গাছ মারা যায়।

দমন ব্যবস্থাপনা :
১. ফসলের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
২. নীরোগ বীজ ব্যবহার করতে হবে।
৩. শস্য পর্যায় অনুসরণ করতে হবে।
৪. রোগ দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে একরোবেট এমজেড (ম্যানকোজেব+ডাইমেথোমরফ) ০৪গ্রাম/লিটার বা হেডলাইন টিম (পাইরাক্লস্ট্রাবিন+ডাইমেথোমরফ) ২.৫০গ্রাম/লিটার বা হেমেনকোজেব বা রিডোমিল গোল্ড বা ইন্ডোফিল এম-৪৫ বা ডায়থেন এম-৪৫ প্রভৃতি ০৪গ্রাম/লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে ৭ থেকে ১০ দিন অন্তর ¯েপ্র করতে হবে।
অথবা ডিফেন্স ৩৫এসসি বা কোগার ২৮এসসি বা এমিস্টার টপ নামক ছত্রাকনাশক ¯েপ্র করতে হবে। ছত্রাকনাশকের মাত্রা হবে প্রতি লিটার পানিতে ০১ মিলি।

পড়তে পারেন: টমেটো চাষে সারের পরিমাণ ও পরিচর্যা

ছত্রাকজনিত ঢলে পড়া রোগ :
চারা অবস্থায় এ রোগ দেখা যায়। কয়েক ধরনের ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়। বীজ ও মাটি দ্বারা এ রোগ বিস্তার লাভ করে। টমেটো গাছের গোড়া ও শিকড়ে বাদামি বর্ণের দাগ পড়ে। পাতা হলুদ বর্ণ ধারণ করে, গাছ ঢলে পড়ে এবং পরে মারা যায়।

দমন ব্যবস্থাপনা :
১. রোগ সহনশীল জাতের চাষ।
২. শস্য পর্যায় অনুসরণ।
৩. রোগ দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিফেন্স ৩৫ এসসি নামক ছত্রাকনাশক ¯েপ্র করতে হবে। ছত্রাকনাশকের মাত্রা হবে প্রতি লিটার পানিতে ০১ মিলি।

ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট :
মাটিতে বসবাসকারী এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এ রোগ ছড়ায়। গাছের ক্ষতের মধ্য দিয়ে এ রোগের জীবাণু ঢুকে পড়ে। আক্রান্ত গাছের পাতা ঢলে পড়ে এবং গাছ মারা যায়।

দমন ব্যবস্থাপনা :
১. আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলা।
২.শস্য পর্যায় অনুসরণ।
৩. স্টেপটোমাইসিন বা ব্যাকট্রোবান নামক ব্যাকটেরিয়ানাশক ¯েপ্র করা। প্রয়োগমাত্রা প্রতি লিটার পানিতে ০৪ গ্রাম।

মোজাইক রোগ :
এটি টমেটোর একটি ভাইরাসজনিত রোগ। বীজ ও কীটপতঙ্গের মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। এ রোগের আক্রমণে পাতায় হলুদ ও সবুজ রঙের ছোট ছোট দাগ পড়ে। রোগের আক্রমণে গাছের বৃদ্ধি কমে যায় এবং ফলন হ্রাস পায়।

পড়তে পারেন: যে কারণে চাষ করবেন শীতকালীন ব্ল্যাক টমেটো

দমন ব্যবস্থাপনা :
১) নীরোগ বীজ ব্যবহার।
২) পোকা দমন। আক্রান্ত গাছ তুলে ফেলা। পোকা দমনের জন্য হলুদ আঠালো ফাঁদ ব্যবহার।

পাতা কোঁকড়ানো রোগ :
এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এক ধরনের সাদা মাছি দ্বারা এ রোগ ছড়ায়। পাতার ফলক কিনার থেকে মধ্য শিরার দিকে গুটিয়ে বা কুঁকড়িয়ে যায়। পাতা খসখসে হয়ে ওঠে এবং হলুদ হয়ে যায়। গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।

দমন ব্যবস্থাপনা :
রোগ প্রতিরোধী জাতের চারা লাগানোর পর নোভাস্টার ৫৬ ইসি ২ থেকে ৩ বার প্রতি লিটার পানিতে ০২ মিলি মিশিয়ে ¯েপ্র করতে হবে। আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। নীরোগ বীজ ব্যবহার করতে হবে। হলুদ আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে।

শিকড়ের গিঁট রোগ :
এটি একটি নেমাটোড বা কৃমিজনিত রোগ। এর আক্রমণে টমেটো গাছের শিকড়ে ছোট ছোট গিঁট দেখা যায়। গিঁটগুলো আস্তে আস্তে বড় হয়। আক্রান্ত গাছের বাড়তি কমে যায় এবং শিকড় পচে গাছ মারা যায়।

দমন ব্যবস্থাপনা :
শস্য পর্যায় অনুসরণ করা। আক্রান্ত জমিতে একরপ্রতি ১৬ কেজি হারে ফুরাডান ৫জি ব্যবহার করতে হবে। জমিতে জো থাকা অবস্থায় গাছের গোড়া থেকে চার-পাঁচ ইঞ্চি দূরে লাঙলের ভাউর টেনে তাতে ফুরাডান ৫জি প্রয়োগ করে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।

এ্রগ্রিকেয়ার/এমএইচ