সজিব ইসলাম, চারঘাট (রাজশাহী) প্রতিনিধি: পড়াশোনা শেষে চাকরি পেয়েছিলেন। করোনা মহামারিতে চাকরি হারিয়ে গেলো। বেকার হয়ে বাড়িতে বসে বসে দিন কাটছিল উজ্জলের। বাড়িতে বেকার বসে না থেকে শুরু করলেন হাঁসের খামার। ব্যাস, বদলে গেলো ভাগ্যের চাকা।

রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার সদর ইউনিয়নের বড়বড়িয়া গ্রামের আব্দুল রাজ্জাক মন্ডলের ছেলে আবু সুফিয়ান উজ্জল।কথা হয় তাঁর সাথে। জানান কষ্ট আর সাফল্যের কথা। উজ্জল বলেন, ২০১৮ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে মাস্টার্স শেষ করে আইটি ফার্মে চাকুরি নিই। এরপর করোনাকালে চাকুরি হারিয়ে বাড়িতে এসে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। বেকারত্ব আর প্রকৃতির নিষ্ঠুরতায় দিশেহারা হয়ে পড়ি।

এক সময় ইউটিউবে হাঁস পালনের ভিডিও দেখে স্থির করি হাস-মুরগী পালনের। পরে খামার শুরুর আগে হাঁস পালনের ওপর ইএসবিপি নামের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিই। প্রশিক্ষণ শেষ করে পরিবারের কাছে থেকে কিছু টাকা নিয়ে ৭৫০ টি পিকিং জাতের হাঁসের বাচ্চা দিয়ে শুরু হয় খামার। অল্পসময়ের মধ্যে হাঁস বিক্রি করে আয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লক্ষ টাকা।

উজ্জল বলেন, বেকারত্বে কঠিন অভিশাপ যাতে করে আমার গায়ে না লাগে এবং বেকারত্বের কারণে বাবা মায়ের ঘারের বোঝা হতে না হয়। সেজন্য ঘরে বসে না থেকে এ খামার শুরুর পরিকল্পনা। আমি এ খামারকে আরো বড় করে এলাকার বেকারত্বে অভিশাপ মোচন করতে চায়। যাতে করে কোন শিক্ষিত ছেলে মেয়েকে লেখাপড়া শেষ করে বাবা মায়ের উপর ভর করে বসে থাকতে না হয়।

এলাকার মানুষের দাবি, গ্রামে বসবাস করা এ তরুণের সাফল্য সাড়া ফেলেছে পুরো এলাকায়। তাকে অনুসরণ করে হাঁস পালনে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন অনেকেই। স্থানীয় তরুণদের কর্মসংস্থানেও সহায়তা করছেন তিনি। তার কাছ থেকে হাঁসের বাচ্চা নিয়ে ৪ জন নতুন করে হাঁসের খামার গড়ে তুলেছেন।

চারঘাট উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, প্রাণিসম্পদ বিভাগের পক্ষ থেকে তরুণ উদ্যোক্তাদের ওষুধসহ খামার স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।

তাক লাগানো সফল খামারি মান্দার জলিল সরদার

করোনা ভাইরাসের মতো যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে কিভাবে টিকে থাকা যায় তার উদাহরণ তাক লাগানো সফল খামারি জলিল সরদার। ডিমের দামে ধস, মুরগির দামে মন্দা; ঠিক সে সময় জলিল সরদার আয় করেন মাসে ৪০ হাজার টাকা!

বাবার পৈত্রিক সম্পত্তি পেয়েছেন নামমাত্র। বরগা জমি ও নিজের সামান্য জমিতে চাষ করে জুটতো না সংসারের খরচ। লেয়ার মুরগির খামার করে সংসারে এনেছেন স্বচ্ছলতা। মুক্তি পেয়েছেন আর্থিক দৈন্যতা থেকে। ১ হাজার লেয়ার মুরগি থেকে এখন তাঁর মাসিক আয় ৪০ হাজার টাকা।

নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার প্রসাদপুর ইউনিয়নের জোতবাজার জমিদারপাড়া এলাকার লেয়ার খামারি আব্দুল জলিল সরদার। দীর্ঘ ১০ বছর ধরে লেয়ার মুরগি পালন করছেন। কঠোর পরিশ্রম আর অভিজ্ঞতার ফলে নিজেকে স্বাবলম্বী করতে সক্ষম হয়েছেন। মোকাবেলা করছেন জীবনের একটির পর একটি কঠিন ধাপ।

এলাকার বেশ কয়েকটি খামারের মধ্যে তিনি এখন সফল মুরগি খামারি হিসেবে পরিচিত। দুই মেয়ে ও ছোট ছেলের পড়াশোনার খরচ, নিজের সংসারের খরচ ছাড়াও মিলছে বাড়তি আয়। খামার থেকে অর্জিত আয় দিয়ে ব্যাংক ঋণ শোধ করা, সংসারের খরচ মেটাতে সক্ষম তারা।

আরোও পড়ুন: এইচএসসি পড়ুয়া সজীবের মুরগির খামার, মাসিক আয় ৪০ হাজার

১০ বছর আগে বাবার ৪ কাঠা জমির উপর খামার শুরু করার করেছিলেন। হাতে টাকার সংকটে নিয়েছিলেন ব্যাংকঋণ। এখন তার ব্যাংকঋণ প্রায় শোধ করে জমিয়েছেন টাকা। আগামীতে তার খামারটা আরও বড় করার জন্য চেষ্টা করছেন। করোনার মধ্যেও খামারে তুলেছেন দেড় হাজার লেয়ারের বাচ্চা। ডিমপাড়া মুরগি বিক্রি করে সেই খাঁচায় তুলবেন নতুন এসব মুরগি।

নওগাঁ জেলার অন্যান্য উপজেলার মতো মান্দা উপজেলার বহু দরিদ্র পরিবার হাঁস, মুরগি, গরু পালনের মধ্য দিয়ে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন, হয়েছে তাদের দিন বদল।

জলিল সরদারের পরিবারে অভাব অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। সংসারের টানাপোড়ন যেন কামড়ে ধরে ছিল। এলাকায় সর্বপ্রথম এক মুরগির খামার দেখে কৃষিকাজ ছেড়ে শুরু করেন লেয়ার মুরগির খামার। এক বছরের মাথায় নিজের সাফল্য দেখে আশ্চর্য হয়ে যান তিনি। ৫০০ মুরগি দিয়ে শুরু করা খামারে এখন দেড় হাজার মুরগি। ডিম বিক্রি করেছেন ৭ টাকা পিস। তবে, করোনায় দাম কমার পর নিজ বাড়িতে খুচরা ডিম বিক্রি করে পুষিয়ে নিচ্ছেন ঘাটতি।

আরোও পড়ুন: বৃদ্ধ বয়সে মুরগির খামার করে স্বাবলম্বী নওগাঁর ছেফাতুল্যা

পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১০ সালের শুরুতে মুরগির খামার করার জন্য ব্যাংক থেকে ৪ লাখ টাকার মতো ঋণ গ্রহণ করেন। দু-বছরের মাথায় ঋণ পরিশোধ করে জমতে থাকে মূলধন। গত ১৩ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে জলিল সরদারের সঙ্গে কথা হলে তিনি এগ্রিকেয়ার২৪.কম কে জানান, আশেপাশের কয়েকটি খামারে ব্রয়লার মুরগির চাষ করলেও ডিমে বেশি লাভ হওয়ায় লেয়ার মুরগির খামার করেছেন তিনি।

তিনি জানান, ডিম, মুরগি ও একদিনের বাচ্চার পাইকারি এক ডিলারের কাছে থেকে ৫০০টি বাচ্চা কিনেছিলেন। এরপর বাড়ির সামনের পুকুর পাড়ে পড়ে থাকা ফাঁকা জায়গাতে গড়ে তোলেন খামার। প্রথমে টাকার সংকুলান না হওয়ায় ৪ লাখ টাকার মতো ঋণ নিয়েছিলেন। বর্তমানে খামারে রয়েছে দেড় হাজার লেয়ার মুরগি। প্রায় ৯০ শতাংশ মুরগি ডিম পাড়ছে। বাড়িতে বিদ্যুৎ লাইন থাকায় সহজেই পানির ব্যবস্থা করতে পেরেছেন তিনি।

জলিল সরদার বলেন, ডিম বিক্রির টাকা দিয়ে মুরগির খাদ্য, অষুধ, ভ্যাকসিন কিনতে হয়। এখন খাদ্যেও দাম বাড়িয়েছে কোম্পানি। কিন্তু ডিমের দাম বাড়েনি। বাড়িতে খুচরা ভাবে কিছু ডিম বিক্রি করে লোকসানের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছি। ৭ টাকাও বিক্রি করছি আবার সাড়ে ৬ টাকাও বিক্রি করছি। ৭টাকা বিক্রি করলে ৬৫-৭০ হাজার টাকা মাসে আয় হতো। আর এখন কম হচ্ছে ৩৫-৪০ হাজার। কারণ, ১৬’শ টাকার খাদ্যেও বস্তা এখন ২ হাজার।

করোনার কারণে ডিমে লোকসান হয়েছে অনেক। খামারিরা লোকসান খেয়েছেন প্রচুর। অনেকে মুরগি তুলতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। প্রতিটি ডিম উৎপাদনে প্রায় সাড়ে ৫ টাকা খরচ হয়ে যায়। ডিম যদি ৭ টাকা পিস থাকে তাহলে কিছুটা লাভ হয়। করোনায় ডিমের বেঁচাকেনা অল্প হওয়ায় নিয়মিত ডিম কিনতে আসত না পাইকাররা। এখন পাইকার আসে তো ডিমের দাম মাটিকাটা (খুবই অল্প)।

আরোও পড়ুন: প্রণোদনার নামে খামারিদের টাকা লোপাট প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার

দেড় হাজার মুরগি প্রায় ১৩ মাস আগে ডিম দেওয়া শুরু করে। বর্তমানে প্রতিদিন খামারে প্রায় ১২৮০ থেকে ১৩০০ ডিম পাওয়া যায়। করোনার কারণে অভাবে মুরগিকে বেশি খাবার খাওয়াতে পারেননি তিনি। তবে, ভ্যাকসিন শিডিউল, ভিটামিন-মিনারেল, খামারের যত্ন করেছেন প্রচুর। এ কারণে মুরগির রোগ দেখা যায়নি।

খুচরা হিসেবে প্রতি হালি মুরগির লাল বাদামি ডিম ৩০ টাকা করে এবং পাইকারি শতকরা হিসেবে ১০০ ডিম বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা থেকে ৬২০ টাকা করে বিক্রি করছেন।

এই খামারি আশা প্রকাশ করে বলেন, অল্প কিছুদিনের মধ্যে ডিমের দাম প্রতিপিস ১ টাকা বাড়লে ব্যয় ছাড়াও দৈনিক উল্লেখযোগ্য টাকা আয় করবেন।

জলিল সরদারের স্ত্রী এগ্রিকেয়ার২৪.কম কে বলেন, ডিমপাড়া মুরগির খামার দীর্ঘমেয়াদি। লাভ হলে ভালো আবার ডিমের দাম কমে গেলে মুরগি হুট করে বিক্রি করে দেওয়া যায় না। এসব মুরগি ১৮ থেকে ২২ মাস বয়স পর্যন্ত নিয়মিত ডিম দেয়। পরে আস্তে আস্তে কমতে থাকে। তাই ২২ মাস বয়সের পরে আমার খামারের মুরগিগুলো বিক্রি করে দেব। তখন এসব মুরগি প্রতিটি কমপক্ষে ৩৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা করে বিক্রি করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি। আর স্বামী -স্ত্রী মিলে খামার আরো বড় করার পরিকল্পনা আছে।

প্রাণিসম্পদ চিকিৎসক আতাউর রহমান এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে জানান, মুরগির রোগ বালাই সাধারণত বেশি হয়। তবে মুরগির ফাউল কলেরা, রানীক্ষেত এবং গামবোরা রোগের সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই বাচ্চার বয়স ১৫ দিন থেকে ৫০ দিনের মধ্যে গামবোরা এবং ৫০ দিনের মধ্যে রানীক্ষেত ও গামবোরা ভ্যাকসিন দিয়ে নিলে এসব মহামারী রোগে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যায়।

আরোও পড়ুন: মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে খামারিদের সহায়তায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার

একই এলাকার খামারি সাইদুর রহমানসহ অনেক গ্রামবাসী জানান, আগেও টাকা পয়সা তেমন ছিল না। মুরগির খামার করায় স্বচ্ছল হয়েছেন। এখন আর আগের মতো নেই। অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এলাকায় একে অপরের দেখাদেখি মুরগি, হাঁসের খামার গড়ে তুলেছেন। তাতে সবারই কমবেশি লাভ হয়। তারা প্রত্যেকেই ব্যবসা ধরে রেখেছেন।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. অভিমাণ্য চন্দ্র এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে জানান, ‘কালিকাপুর, পরানপুর, প্রসাদপুর এসব ইউনিয়নে গরু, ব্রয়লার মুরগি, সোনালি, লেয়ার মুরগির খামার গড়ে উঠেছে। অনেকেই লাভবান হয়েছেন আবার কিছুকিছু খামারি ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। উপজেলায় গরুর খামার রয়েছে ১৩’শ ৮৫ টি, মুরগির খামার ৮৭ টি। ব্রয়লার মুরগির খামার রয়েছে ২১০ টি, লেয়ার মুরগি খামার রয়েছে ৩১ টি।

তিনি আরো জানান, লেয়ার মুরগি পালন একটি একটি লাভজনক ব্যবসা। যে কোনো বেকার নারী-পুরুষ লেয়ার পালনে এগিয়ে এলে সরকার প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা করবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এতে করে কমবে বেকারত্ব, বাড়বে কর্মসংস্থান। উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে হাঁস খামারি ও বাড়িতে পালনকারীদের নিয়মিত পরামর্শ সেবা দেওয়া হচ্ছে।