ড. এম. মনজুরুল আলম মন্ডল, প্রিন্সিপাল সায়িন্টিফিক অফিসার, বিনা: এখন কাঁচা আম পাওয়া যাচ্ছে। আম যদিও আমাদের জাতীয় ফল নয়, তবে অবশ্যই প্রিয় ফল। অন্য যে কোন ফলের চেয়ে এই ফলটি বেশির ভাগ মানুষ পছন্দ করে। কাঁচা আমের স্বাস্থ্য উপকারিতার কথা জানলে আপনি বুঝতে পারবেন কাঁচা আম খাওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা।

আম কাঁচা অথবা পাকা যেভাবে ই খাওয়া হোক তা আমাদের শরীরের জন্য খুবই উপকারী। অনেক ক্ষেত্রে পাকা আমের তুলনায় কাঁচা আমের গুণ আরও বেশি। কাঁচা আমের গুণাগুণ সম্পর্কে জেনে সত্যিই অবাক হতে হয়। কাঁচা আম প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন, মিনারেল ও পানিতে ভরপুর।

প্রতি ১০০গ্রাম আমে রয়েছে ৭০ কিলোক্যালরি কার্বোহাইড্রেট, ১৭ গ্রাম প্রোটিন, ০.৫ গ্রাম চর্বি, ০.২৭ গ্রাম খাদ্য আঁশ, ১.৮০ গ্রাম ফলেট, ১৪ গ্রাম নায়াসিন, ০.৫৮৪ মিলিগ্রাম প্যান্থোথেনিক এসিড, ০.১৬০ মিলিগ্রাম প্যরিডক্সিন (ভিটামিন “বি৬”), ০.১৩৪ মিলিগ্রাম রাইবোফ্লাবিন, ০.০৫৭ মিলিগ্রাম থায়ামিন, ০.০৫৮ মিলিগ্রাম ভিটামিন “সি, ২৭.৭ মিলিগ্রাম ভিটামিন “এ, ৭৬৫ IU ভিটামিন “ই”, ১.১২ মিলিগ্রামভিটামিন “কে, ৪.২ মাইক্রোগ্রাম সোডিয়াম, ২ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম, ১৫৬ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ১০ মিলিগ্রাম কপার/তামা, ০.১১০ মিলিগ্রাম আয়রন/লৌহ, ০.১৩ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম, ৯ মিলিগ্রাম ম্যাঙ্গানিজ, ০.০২৭ মিলিগ্রাম জিংক/দস্তা, ০.০৪ মিলিগ্রাম বিটা-ক্যারোটিন, ৪৪৫ মাইক্রোগ্রাম আলফা-ক্যারোটিন।

কাঁচা আম সাধারণত আচার বানানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও জুস, চাটনি, সস, জ্যাম এবং ফলি হিসেবে খাওয়া হয়। তবে সবচাইতে আকর্ষণীয় হচ্ছে কাঁচা আমের ভর্তা। আসুন তাহলে জেনে নেই কাঁচা আমের স্বাস্থ্য উপকারিতাগুলো সম্পর্কে।

ক্যারোটিন ও ভিটামিন সমৃদ্ধ কাঁচা আম চোখ ভালো রাখে। আমে রয়েছে প্রচুর কার্বোহাইড্রেট, যা কর্মশক্তি প্রদানে সাহায্য করে। বিটাক্যারোটিন থাকায় হৃৎপিন্ডের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। ভিটামিন বি-১ও ভিটামিন-২ ভাল পরিমাণে রয়েছে। ক্যালসিয়াম ও আয়রন রয়েছে। পরিশ্রমী বা নিয়মিত ব্যায়াম করার অভ্যেস থাকলে কাঁচা আম খেতে পারেন। পটাশিয়ামের অভাব পূরণ করে।

পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম প্রচুর পরিমাণে থাকায় অ্যাসিডিটি বা অম্বল, পেশি সংকোচন, মানসিক চাপের ফলে তৈরি শারীরিক সমস্যায় উপকারী। উচ্চমাত্রার পটাশিয়াম শরীরের রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। কাঁচা আমে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকায় তা আমাদের শরীরের রক্ত পরিস্কার রাখে এবং অ্যানিমিয়াবা রক্তাল্পতা সমস্যায় বেশ উপকারী। ফাইবার বা আঁশসমৃদ্ধ হওয়ায় কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।

এছাড়া কোলন বা মলাশয়ে ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। কলেরা, রক্তাল্পতা ও যক্ষা প্রতিরোধে সাহায্য করে। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ হওয়ায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষম তা গড়ে তোলে ও গরমের সময় সর্দি গর্মি থেকে রক্ষা করে। কাঁচা আমে অধিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে। এইঅ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যান্সার এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শরীরকে রক্ষা করে। আমের বীজ শুকিয়ে চূর্ণ করে ডায়রিয়া সারা তে ব্যবহার করা হয়।

নিফ্রাইটিস বা বৃক্ক প্রদাহ এবং কিডনির সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে। নিঃশ্বাসের সমস্যা, জ্বরের সমস্যা উপশম করে। অ্যালকালাইন জাতীয় খাবার হওয়ায় অ্যাসিডিটিউপশমে ভাল কাজ করে। খাদ্যাভ্যাসের জন্য বেশির ভাগ মানুষই এসিডিটির সমস্যায় ভুগে থাকেন। কাঁচা আম খেলে এসিডিটির সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ঔষধ গ্রহণ ছাড়াই আপনার হজমে সাহায্য করবে কাঁচা আম।

গরমে আমাদের শরীর থেকে অনেক পানি বাহির হয়ে যায়। শরীরের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য এবং পানির ঘাটতি পূরণের জন্য সামান্য লবণ দিয়ে কাঁচা আম খান। আমে রয়েছে ক্যালসিয়াম, যা হাড় সুগঠিত করে। আম হাড় ও দাঁতের সুস্থতা বজায় রাখতে অনেক সাহায্য করে। সুতরাং আম খাওয়া অনেক প্রয়োজন প্রতিটি মানুষের জন্য। এতে হাড় ও দাঁত সুস্থ থাকবে।

অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ হওয়ায় অ্যান্টি-ভাইরাস ও অ্যান্টি-ক্যান্সার উপাদান রয়েছে। ত্বক উজ্জ্বল রাখতে আমের পাল্প বা আঁশ সাহায্য করে। আম পাতলা করে কেটে ত্বকের ও পর কিছুক্ষণ রেখে মুখ ধুয়ে ফেলুন। রোম কূপের মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার সমস্যা কমে যাবে। কাঁচা আম শুকিয়ে তৈরি করা আমচূরগুঁড়া স্কার্ভি সারানোয় কার্যকর। যথেষ্ট পরিমাণে টাটকা শাকসবজি ও ফলমূল না খাওয়ার ফলে সৃষ্ট রক্ত ঘটিত রোগই হচ্ছে স্কার্ভি।

কিডনির সমস্যা প্রতিরোধ সাহায্য করে। লিভার ভালো রাখে। আমের বীজ শুকিয়ে চূর্ণ করে ডায়রিয়া সারাতে ব্যবহার করা হয়। আম পাতলা করে কেটে ত্বকের ও পর কিছুক্ষণ রেখে মুখ ধুয়ে ফেলুন। রোম কূপের মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার সমস্যা কমে যাবে। স্কার্ভি, অ্যানেমিয়া ও মাড়ির রক্ত পড়া কমায় কাঁচা আম। কাঁচা আমের পাউডার বা আমচুর স্কার্ভি নিরাময়ে অত্যন্ত কার্যকরী। কাঁচা আম আলফা ক্যারোটিন ও বিটাক্যারোটিনের মত ফ্লাভনয়েড সমৃদ্ধ।

এইসব উপাদান দৃষ্টি শক্তি ভালোরাখে ও দৃষ্টিশক্তির উন্নতি ঘটায়। এই ফলে  রয়েছে উচ্চমাত্রার গ্লুটামাইন এসিড নামক এটি প্রোটিন যা মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি বাড়াতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। লেখাপড়ায় অমনোযোগী বাচ্চাদের আম খেতে দেয়া উচিত।

শরীরে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারি উপাদান টক্সিন ধ্বংস করতে কাঁচা আমের বিকল্প নেই। এছাড়া কাঁচাআমের কল্যাণে মুখের ভেতরের যে কোনো রকমের ঘাদ্রুত নিরাময় হয়। গর্ভবতী  অবস্থায় মায়েরা কাঁচা আম খেলে  অ্যান্টিবায়োটি কক্ষমতা বেশি থাকে  সন্তানের। ফলে  জন্মানোর পর খুব কমই রোগে আক্রান্ত হয় শিশুরা। কাঁচাআম খেলে শরীরের অতিরিক্ত ক্ষতিকর পানি থেকে দেহকে রক্ষা করে এবং শরীরের তৃষ্ণা মিটায়। কাঁচা আম পেক্টিন (pectin) একটি সমৃদ্ধশালী উৎস, মধু এবং লবণ দিয়ে মিশিয়ে গ্যাস্ট্রোইন টেস্টাইনাল রোগের চিকিৎসায় অত্যন্ত উপকারী।

কাঁচাআমের সঙ্গে চিনি, জিরা এবং চিম্টিলবণ, মিশিয়ে সেদ্ধ করে জুস করে খেলে ঘামাচিরোধ করতে সাহায্য করে এবং গ্রীষ্মকালে স্ট্রোকের ঝুকি হতে রক্ষা করে। যারা ওজন কমাতে চান তারা কাঁচা আম নির্দ্বিধায় খেতে পারেন। কারণ শরীরের চর্বি কাটতে কাঁচা আমের জুড়ি নেই। গ্রীষ্মকালের সবচেয়ে খারাপ শত্রু হচ্ছে ঘামাচি। ঘামাচির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সবচেয়ে ভালো উপায় কাঁচা আম খাওয়া। কাঁচা আমে এমন কিছু উপাদান আছে যা সানস্ট্রোক হতে বাধা দেয়।

যারা আম খেয়ে থাকেন তাদের মাঝে অ্যাজমা হওয়ার সম্ভাবনা কম। এটি আমের একটি চমকপ্রদ স্বাস্থ্য উপকারিতা। এতে থাকা উচ্চবিটাক্যারোটিন অ্যাজমা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণভূমিকা রাখে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড খড়রৌদ্রে একটি আমের রসের সাথে সামান্য পানি, একটেবিলচা মচ মধু মিশিয়ে খেলে তাৎক্ষণিক ভাবে শরীর ঠাণ্ডা হয় এবং হিটস্ট্রোক প্রতিরোধ হয় এ বং গরমের কারণে হওয়া স্ট্রোকের সম্ভাব না হ্রাসে কাঁচা আম ও জিরা বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

প্রতিদিন আম খেলে দেহের ক্ষয় রোধহয় ও স্থূলতা কমিয়ে শারীরিক গঠনে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। আপনি কি জানে ন কাঁচাআম আপনাকে প্রচুর এনার্জি দিতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে দুপুরের খাওয়ার পরে কাঁচা আম খেলে তন্দ্রা কাটিয়ে উজ্জীবিত হতে সাহায্য করে।

পরিশ্রমী বানিয়মিত ব্যায়াম করার অভ্যেস থাকলে কাঁচা আম খেতে পারেন। পটাশিয়ামের অভাব পূরণ করতে পারে। তাই বেশি বেশি কাঁচা আম খেয়ে, শরীরের বিভিন্নরোগের প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি করুন। যা হোক, কাঁচা আমের কষ মুখে লাগলে ও পেটে গেলে মুখে, গলায় ও পেটেইনফেকশন হতে পারে। তাই এ ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে। তাই এই মৌসুমে বেশি করে আম খান। নিজের শরীরকে সুস্থ রাখুন।

লেখক: ড. এম. মনজুরুল আলম মন্ডল, প্রিন্সিপাল সায়িন্টিফিক অফিসার, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ।