সজিব ইসলাম, চারঘাট (রাজশাহী) প্রতিনিধি: মধুচাষি আব্দুল আলীম (২৮) ‘মধু আলীম’ নামেই পরিচিত। বাড়ি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার নিমপাড়া ইউনিয়নের বালাদিয়াড় গ্রামে। দারিদ্রতার ছোবলে পড়াশুনা করতে না পারা আলীম এখন বছরে আয় করেন ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা!

সি.এম.ই.এস প্রজেক্ট থেকে মধু চাষের প্রাথমিক ধারণা লাভ করেন তিনি। অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমেই মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহ করে বর্তমানে তিনি স্বাবলম্বী হয়েছেন।নিজের ভাগ্যের শ্রষ্ঠা নিজেই হয়ে করেছেন ভাগ্যবদল। দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে মধু চাষ করে আব্দুল আলীম বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।

২০০৭ সালে মাত্র ৪টি মধুর বাক্স নিয়ে শুরু হয় মধু আলীমের পথচলা। এখন তার খামারে দেড় শতাধিক মধুর বাক্স রয়েছে, যেগুলোর প্রতিটির মূল্য ৭ থেক ৮ হাজার টাকা। বছরে প্রায় ৬-৮ টন করে মধু উৎপাদন করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানোর পাশাপাশি প্রাণ কোম্পানিসহ বিভিন্ন কোম্পানির কাছে মধু সরবারহ করেন তিনি।

কোম্পানিতে ও দোকানে ছাড়াও অনলাইনের মাধ্যমেও তিনি মধু বিক্রয় করে থাকেন । যার ফলে তার অনলাইন মধুর ব্যবসাও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

সরেজমিনে চারঘাট উপজেলা সদর থেকে ১৭ কিলোমিটার দুরে উপজেলার বালাদিয়াড় তার নিজ খামারে গিয়ে কথা হয় আলীম এর সাথে তিনি এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, ‘শখের বসেই ২০০৭ সালে ২ হাজার ৬০০ টাকা দিয়ে মাত্র ৪টি মধুর বাক্স কিনে সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহ শুরু করি। পরে চাকরির আশা না করে মধুর বাণিজ্যিক চাষ করে আসছি’।

এই চাষি বলেন, ‘বর্তমানে আমার মধু খামারে ৫ জন সহযোগী সারা বছরই মধু উৎপাদন করেন। “২০১৫-১৬ বছরে ২ টন, ২০১৬-২০১৭ বছরে ৩ টন ও ২০১৮-২০১৯ বছরে ৪ টন মধু পেয়েছি। এ বছরও আরও দ্বিগুণ পরিমাণ পাওয়ার আশা করছি। এবার ৮ টনের বেশি মধু পাওয়া যাবে।”

তার এই সফলতা দেখে ওই এলাকার কয়েকজন তরুন এই মধু চাষের সাথে যোগ দেন। আব্দুল আলীম আরও বলেন, প্রথমদিকে আমার কোনো পুজি ছিলোনা বাড়ি থেকে সামান্য কিছু টাকা নিয়ে মৌমাছির ১০টি বাক্স তৈরি করে নিজ এলাকার মাঠে মধু চাষ শুরু করেছিলাম।

মৌচাষের আয় ও ব্যয় সম্পর্কে তিনি জানান, যত বেশি মৌ বাক্স স্থাপন করা যাবে আয়ের পরিমাণ তত বেশী হবে। নভেম্বর থেকে জুন মাস পর্যন্ত মৌবাক্স থেকে আয় করা সম্ভব হয়। জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত তেমন কোন ফুলের সমারোহ না থাকায় মৌমাছি খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে না। এ সময় তাদের কৃত্রিম খাদ্য সরবরাহ করতে হয়। দশটি মৌবাক্সোর জন্য সপ্তাহে ৮ কেজি করে খাদ্য দিতে হয় যার মূল্য আসে চারশত টাকা। এভাবে ৫ মাস খাদ্য দিতে হয়।

সাফল্যের নাগাল পাওয়া আব্দুল আলীম আগামী বছর আরও দুই শতাধিক মৌমাছির বাক্স তৈরি করার পরিকল্পনা করেছেন। মধু চাষ শুরু করে তার ভাগ্যের চাকা অনেকটাই বদলে গেছে। বর্তমানে তিনি অনেকটাই স্বাবলম্বী।

আলীম বলেন, ‘গত বছর খামার থেকে এবং বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ও কোম্পানির কাছে ৩০০ টাকা কেজি দরে মধু বিক্রি করেছি। বেশিরভাগ কোম্পানিই স্বল্পমূল্যে মধু কিনে নিয়ে তাতে কেমিক্যাল মিশিয়ে চড়া দামে বিক্রি করে। গাছি মধু সংগ্রহকারীরা মৌচাকে চাপ দিয়ে সংগ্রহ করেন। এতে মধুর গুণাগুণ ৪০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। আর আমার খামারে যন্ত্রের সাহায্যে বাতাস দিয়ে সংগ্রহ করি। এতে আমাদের মধুর গুণাগুণ অক্ষুণ্ন থাকে’।

এ বিষয়ে চারঘাট উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা শামীম আহমেদ এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে জানান, মৌচাষের উপর বেকার যুবকদের আগ্রহ বেড়েছে। ভ্রাম্যমান মৌচাষিরা সরিষার ফুল ছাড়াও কালিজিরা, লিচু ও বনের ফুল থেকে মধু আহরনে মনোযোগি হচ্ছেন। এতে করে এলাকায় মৌচাষ ও মধু আহরন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

চারঘাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, ‘উপজেলার মৌ-খামারি আব্দুল আলীম মধুর চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তার সাফল্য দেখে আরও অনেকেই বাণিজ্যিকভাবে মধু চাষ ও সংগ্রহে আগ্রহী হচ্ছেন। কৃষি অফিস থেকে মধু চাষে যাবতীয় পরামর্শ প্রদান করা হয়।

করোনায় চাকরি হারিয়ে অভাব জয়ের পথ দেখাল মাসরুম!

সাইদুর রাহমান (৪৫) চাকরি করতেন রাজধানীর এক বেসরকারি হাসপাতালে। করোনার প্রথম ঢেউ টিকতে পারলেও দ্বিতীয় ঢেউ আসার আগেই চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েন। কীভাবে সংসার চলবে, এ চিন্তা করতে করতে হঠাৎ মাথায় আসে মাশরুম চাষের কথা। শেষপর্যন্ত অভাব জয়ের পথ দেখাল মাসরুম!

সাইদুরের দ্বাদশ শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে সাজিদ হোসেন আরাফাত। ইউটিউবে মাসরুম চাষের ভিডিও দেখে বাবাকে জানান ইচ্ছার কথা। স্বল্প পুঁজিতে দ্বিগুণ লাভের মাসরুম চাষে নেই তেমন পরিশ্রম। নিয়ম করে দু-বেলা পানি ছিঁটিয়ে যার যত্ন করতে হয়। এতেই হাজার হাজার টাকা লাভ করা যায়। বিষয়টি বুঝাতে সক্ষম হয় আরাফাত।

এদিকে মাসরুম চাষের ওপরে আরাফাত অনলাইনে একটি কোর্স সম্পন্ন করেন। কুরিয়ারের মাধ্যমে রাজধানীর মোহাম্মদপুর আঁটিবাজার থেকে আনেন মাসরুম বীজ প্যাকেট বা স্পন প্যাকেট। ৮ কেজি স্পন বাসায় পৌঁছাতে খরচ হয় ১ হাজার টাকা। ২ থেকে ৩ হাজার টাকা খরচ করে তৈরি হয় ৫৮টি ছত্রাকের প্যাকেট বা সিলিন্ডার। যা থেকে উৎপন্ন হয় ৫ থেকে ৭ হাজার টাকার মাসরুম!

গত ১০ এপ্রিল ২০২১ নওগাঁর মান্দা উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে ১১ নম্বর কালিকাপুর ইউনিয়নের চকরামাকান্ত দহপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ১২ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৬ ফুট প্রস্থের দ্বিতল ঘরে মাসরুমের পরিচর্যা করছেন সাইদুর রহমান। ঘরের ছাঁদের সাথে সিঁড়ি পদ্ধতিতে আটকানো লাইনলের দড়ি। তাতে এক-একটি ছত্রাকের প্যাকেট সাজানো।

প্যাকেটের মাশরুম বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানালেন, তিনি ওয়েস্টার জাতের মাশরুম চাষ করেন। মাশরুমের পাশাপাশি এ বছর মুরগি পালন শুরু করেছেন। এখন তাঁর জীবন জীবিকার উৎস মাশরুম চাষ, মুরগি পালন ও ছোট একটি মুদিখানা দোকান। করোনায় চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ায় খুব দুশ্চিন্তা ছিল। ছেলের কথায় সাঁয় দিয়ে শুরু করেন মাসরুম চাষ। ছেলে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে মাশরুম চাষের ওপর অনলাইনে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ নেওয়ায় বেগ পেতে হয়নি। প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর ঢাকা থেকে বীজ এনে ওয়েস্টার জাতের মাশরুমের চাষ শুরু করছেন।

সাইদুর রহমান আরও জানান, বর্তমানে তাঁর ঘরে ৫৮টি মাশরুম বীজ প্যাকেট বা স্পন প্যাকেট রয়েছে। আশেপাশের লোকজন এসে মাশরুম কিনে নিয়ে যান। যখন বেশি উৎপাদন হয় তখন মাঝে মাঝে বাজারেও বিক্রির জন্য নিয়ে যান। এ বছর জানুয়ারি থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ৭ হাজার টাকার মাশরুম বিক্রি করেছেন। অথচ দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা বিনিয়োগ করতে হয়েছে। একেকটি স্পন প্যাকেট তৈরি করতে তাঁর ৩০ টাকা খরচ হয়। আর এমন স্পন প্যাকেট বিক্রি হয় সাড়ে ৪০০ টাকায়। প্রতি কেজি মাশরুম বিক্রি করেন ২৫০ থেকে ২৮০ টাকায়।

কথা হয় সাইদুরের ছেলে আরাফাতের সঙ্গে। আরাফাত জানান, মাশরুম চাষের জন্য দেড় বা দুই ইঞ্চি শুকনো খড় সেদ্ধ করতে হয়। এরপর সেদ্ধ খড় শুকাতে হয় হালকাভাবে। যাতে চাপ দিলে পানি না ঝরে। নানা উপাদান দিয়ে সেসব খড় প্লাস্টিকের পলিথিনে বা প্লাস্টিকের স্পন প্যাকেটে রেখে তাতে মাশরুমের বীজ দিতে হবে। ওয়েস্টার জাতের মাশরুম ২০ থেকে ২৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় চাষ শুরু করতে হবে। দিনে ৮-১০ বার স্পনগুলোতে পানি দিতে হয়। একমাসের মাথায় পলিথিনের গায়ে সুক্ষ ছিদ্র দিয়ে বের হবে মাসরুমের ছাতা। সেখান থেকে কেটে বিক্রির উপযোগী মাসরুম আলাদা করতে হয়। সাইদুর নিজেই এখন বাড়িতে উৎপাদিত মাশরুম খাচ্ছেন। পাশাপাশি বাইরেও বিক্রি করছেন।

আরোও পড়ুন: মাছ চাষে কোটিপতি রাজশাহীর সোহরাব

মাসরুম চাষের ভবিষৎ পরিকল্পনার জানতে চাইলে এই মাসরুম চাষি এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, এলাকায় মাসরুম তেমন পরিচিত নয়। মাইকিং করে, লিফলেট লাগিয়ে প্রচারণা চালিয়েছি। অনেক ডায়াবেটিস রোগী, আবার কিছু সাধারণ মানুষ চাহিদা দেখিয়েছে। বড় পরিসরে করব বলে চিন্তা করেছি। প্রথমবার ভালো বীজ পাইনি তারপরও ভালো লাভ হয়েছে। উৎপাদন করা খুব সহজ হলেও বিক্রি করতে অনেকটাই ঝামেলা। এলাকার মোড়ে অনেককে নিজ হাতে চপ বানিয়ে খাইয়েছি। তারা ভালো বললেও পরে আগ্রহ করে কেনে না। যদি বিক্রির নিশ্চয়তা থাকত তাহলে কাজটি আরোও সহজ হতো।

এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি অফিসার সালমা শারমিন এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, মাসরুম চাষি সাইদুরের মাসরুম প্রজেক্ট দেখেছি। আমরা কিছু কিনেছিলাম। মাসরুম চাষে মার্কেটিং সবচেয়ে বড় বিষয়। আমাদের কৃষি বিভাগে মাসরুম চাষের একটা বরাদ্দ এসেছিল, সেটা এখন আর নেই। তবে, তাঁর উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। পরবর্তীতে কোন প্রজেক্ট আসলে তাঁর জন্য থাকবেই। আর যদি এখন মাসরুম বিক্রি করতে সমস্যা হয় তাহলে আমরা ব্যক্তিগতভাবে কিনতে পারি। তবে, বিক্রির বিষয়টি আপাতত নিজেকেই খুঁজতে হবে।

১১ নম্বর কালিকাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল আলিম এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, আমার এলাকায় কেউ যদি ইনোভেটিভ কাজ করতে চায় তাহলে তাকে সার্বিক সহায়তা দেওয়া হবে। কৃষি কাজের ক্ষেতে কোন সহায়তা আসলে তাঁর বিষয়টি আমরা বিবেচনা করে দেখব।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ