অর্থ-বাণিজ্য, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: চলতি মৌসুমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাইরে ফ্রান্সের গম রফতানি কমার পূর্বাভাস দিয়েছে দেশটির কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত কৃষি ও সামুদ্রিক পণ্য বিভাগ ফ্রান্সএগ্রিমার।

সম্প্রতি ইইউর বাইরে গম রফতানির পূর্বাভাস কমিয়েছে। মূলত কৃষ্ণ সাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্য মন্দার মুখে পড়েছে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এ নিয়ে টানা চার মাসের মতো পূর্বাভাস কমানো হলো।

মাসভিত্তিক সরবরাহ ও চাহিদা আউটলুকে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, ২০২১-২২ বিপণন মৌসুমে ফ্রান্স ব্লকের বাইরে ৮৯ লাখ টন গম রফতানিতে সক্ষম হবে। অথচ জানুয়ারিতে দেয়া পূর্বাভাস ৯০ লাখ টনের কথা বলা হয়েছিল।

পড়তে পারেন: গমের পাতা পোড়া রোগের সমাধান

তবে ব্লকের অভ্যন্তরে রফতানি বাড়ার সম্ভাবনা দেখছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। পূর্বাভাস অনুযায়ী, ইইউ অঞ্চলে রফতানি ৭৮ লাখ টনে উন্নীত হতে পারে। আগের মাসের পূর্বাভাসে ৭৭ লাখ টন রফতানির কথা বলা হয়েছিল।

ফ্রান্সএগ্রিমারের কৃষিপণ্য বিভাগের প্রধান মার্ক জি বি বলেন, ইইউ অঞ্চলের বাইরে রফতানি কমে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে আলজেরিয়া। দেশটি ফ্রান্সের সবচেয়ে বড় রফতানি গন্তব্য। কিন্তু আলজেরিয়ায় অব্যাহতভাবে রফতানি কমছে। মূলত দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সংকট ও আলজেরিয়ায় রাশিয়ান গমের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

পড়তে পারেন: মজুদ থেকে গম বিক্রি করবে চীন

এদিকে গম নিয়ে বিশ্ববাজারে নতুন সংকেত দেখা যাচ্ছে। কয়েক ধাপে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হওয়ায় বিশ্বের বৃহৎ উৎপাদক দেশগুলোর গম উৎপাদন ও রফতানির সম্ভাবনা কমে গেছে। ফলে প্রতিষ্ঠানটিসহ কয়েক ডজন বৈশ্বিক আমদানিকারক উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ গম সরবরাহে হিমশিম খাচ্ছেন। এসব গম রুটি, নুডলসসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্য তৈরিতে ব্যবহার হয়।

চলতি বছরের অক্টোবরে মধ্যপ্রাচ্যের একটি ময়দা কারখানা ২ কোটি ৩০ লাখ ডলারের বেশি দামে অস্ট্রেলিয়া থেকে এক কার্গো উচ্চজাতের গম ক্রয় করে। বর্তমানে এর চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি দাম দিয়ে আরো এক কার্গো গম কিনতে ইচ্ছুক প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু অঞ্চলটির রফতানিকারকরা বেশি দাম দিয়েও পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছেন না।

পড়তে পারেন: ভারত থেকে গম আমদানি বেড়েছে, কমতে পারে দাম

যেসব ব্যবসায়ী উচ্চমানের গম বিক্রি করেন, তারা বর্তমানে বিকল্প উৎসের মাধ্যমে সরবরাহ নিশ্চিতের চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে ক্রেতারা খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন। বিষয়গুলো কৃষিপণ্যটির দাম কয়েক বছরের সর্বোচ্চে নিয়ে যেতে সহায়তা করেছে।

সর্বশেষ উৎপাদন ঘাটতি দেখা দেয় অন্যতম শীর্ষ দেশ অস্ট্রেলিয়ায়। চলতি মৌসুমে দেশটি রেকর্ড ৩ কোটি ৪৪ লাখ টন গম উৎপাদনের সম্ভাবনা দেখেছিল। কিন্তু অপর্যাপ্ত ও বিলম্বিত বৃষ্টিপাতের কারণে সে আশায় গুড়ে বালি। শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে কমছে প্রোটিন লেভেলও।

পড়তে পারেন: বিশ্বজুড়ে গম উৎপাদন কমছে, বাড়তে পারে দাম

মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় খাদ্যশস্য সরবরাহকারী এক ব্যবসায়ী জানান, শীর্ষ রফতানিকারক রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর বিশ্ববাজার অনেকাংশেই নির্ভরশীল। কিন্তু এসব দেশের নেতিবাচক উৎপাদন পরিস্থিতির কারণে কয়েক সপ্তাহজুড়ে আন্তর্জাতিক বাজারে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে। আপনি উচ্চ মানসম্পন্ন গমের ক্রয়াদেশ দিয়ে থাকলেও বাস্তবে কী পাচ্ছেন, তা নিয়ে কিন্তু অনিশ্চয়তা থেকেই যায়।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, উৎপাদন মৌসুম শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার নিম্নমানের সাদা গম ও প্রিমিয়াম সাদা গমের দামের পার্থক্য দাঁড়ায় টনপ্রতি ৪৭ ডলারে। অথচ কয়েক মাস আগেও দামের ব্যবধান ছিল ৮-১০ ডলার। বিষয়টি অসম গুণগত মানের দিকেই ইঙ্গিত করছে।

পড়তে পারেন: গম রফতানিতে রাশিয়াকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ইউক্রেনের

গমের বাজারের এ উদ্বেগ সারা বিশ্বেই অনুভূত হচ্ছে। এ ধারাবাহিকতায় গত মাসে শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডে আন্তর্জাতিক বাজার আদর্শ গমের দাম নয় বছরের সর্বোচ্চে উন্নীত হয়। এ সময় বিশ্বের শীর্ষ গম রফতানিকারক রাশিয়া ও চতুর্থ রফতানিকারক অস্ট্রেলিয়ায় পণ্যটির দাম সর্বকালের সর্বোচ্চে উঠে আসে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) জানায়, অক্টোবরে খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক দাম এক দশকের সর্বোচ্চে পৌঁছেছে। বাজারের এমন ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার পেছনে দায়ী করা হচ্ছে গম এবং অন্যান্য খাদ্যশস্য ও ভোজ্যতেলকে।

পড়তে পারেন: গমে বিশ্ববাজার দখল করছে ইউক্রেন

এর মধ্যে যেসব দেশ এখনো করোনায় সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি, তাদের জন্য গমের এমন ঊর্ধ্বমুখিতা ভীতিকর রূপ ধারণ করেছে। পাশাপাশি পণ্য জাহাজীকরণ ব্যয় ১০ বছরের সর্বোচ্চে উঠে আসায় পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করেছে।

এদিকে বিশ্বের শীর্ষ গম মিলাররা চলতি বছরের শুরুর দিকে অতিরিক্ত দামের কারণে গমের মজুদ বাড়াতে কার্পণ্য করেন। তাদের প্রত্যাশা ছিল, অস্ট্রেলিয়ায় কৃষিপণ্যটির উৎপাদন বৃদ্ধির যে পূর্বাভাস মিলেছে, তা ফলে গেলে দাম পড়তে পারে। কিন্তু এ পূর্বাভাস উল্টো দুঃস্বপ্নে রূপ নিয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ মিলারদের কাছে গমের মজুদ স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কমে গেছে। অন্যদিকে বৈরী আবহাওয়ার কারণে শীর্ষ রফতানিকারক রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম উচ্চমানের গম সরবরাহ করছে। চলতি বিপণন মৌসুমে রাশিয়ার গম উৎপাদন কমতে পারে। রফতানি ৩৪ শতাংশ কমার আশঙ্কা রয়েছে।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ