নিজস্ব প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৪ সালে ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে এমবিএ শেষ করেন আবু সালেহ তারেক। আর দশজন পিতামাতার মতোই তারেককে সরকারি করতে বলেন পরিবার। কিন্তু অটল অনঢ় মনোবল-চাকরি নয়; উদ্যোক্তা হবেন তিনি। মাত্র ৮ বছরের মাথায় দেশের সেরা মৎস্যচাষি হিসেবে খোদ প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে নিয়েছেন স্বর্ণপদক।

দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার মৎস্যচাষি আবু সালেহ তারেক। উপজেলার পৌর শহরের পুরাতন বাজার এলাকার অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক এ কে এম শাহাজাহানের ছেলে। তিন ভাইয়ের মধ্যে বড়ভাই শিক্ষকতার সাথে যুক্ত, মেজভাই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। কিন্তু আবু সালেহ উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছেন দেশব্যাপী।

এই তরুণ উদ্যোক্তার সাথে কথা হয় এগ্রিকেয়ার২৪.কমের। তিনি এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে তাঁর সফলতার গল্প শোনান। বিশ^বিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার পর পরিকল্পনা অনুযায়ী নেমে পড়েন কাজে। পৈতৃক তিন বিঘার একটি পুকুরে শুরু করেন মাছ চাষ। বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খামারের নাম দেন মায়ের নামে ‘তাজ অ্যাগ্রো ফার্ম’।

পড়তে পারেন: মাছ চাষে কোটিপতি ফরহাদ, চলতি বছরে ৭০ লাখ!

এখন তার ৬৬ বিঘা জমির ওপর ১৩টি পুকুরে চাষ করা হচ্ছে মাছ। এসব পুকুরে চাষ হচ্ছে দেশীয় প্রজাতির রুই, পাবদা, শিং, কই, মাগুর, টেংরা মাছ। এছাড়া রেণু থেকে পোনা উৎপাদনের কাজও করছেন তিনি। তাঁর খামারে এলাকার বেশকিছু মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। বর্তমানে খামারে কাজ করছেন ১২ জন। গুণগত মানের পোনা উৎপাদন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে মাছ চাষ সম্প্রসারণে অবদান রাখায় দেশের শ্রেষ্ঠ মাছচাষি হিসেবে পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০২২ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে দেশের শ্রেষ্ঠ মাছচাষি হিসেবে স্বর্ণপদক ও ৫০ হাজার টাকা গ্রহণ করেন এই স্বপ্নচারী তরুণ।

আবু সালেহ এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, শুরুটা খুব ভালো ছিল না। আমাদের সমাজের একটা বড় সমস্যা কিংবা আকাঙ্খা হলো বিশ^বিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে সরকারি চাকরি করা। আসলে সরকারি চাকরি নিজের জন্য হলেও আশেপাশের মানুষের উপকারের বা কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকে না। অথচ একজন উদ্যোক্তা কমপক্ষে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৩০ থেকে ৫০ জন মানুষের কর্মসংস্থান করতে পারে। একদিকে দেশ পুষ্টি ও স্বনির্ভর হবে অন্যদিকে অন্যের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ মিলবে।

পড়তে পারেন: কসাই থেকে মাছ চাষে কোটিপতি আইনাল

মাছ চাষে পরিবারের প্রতিবন্ধকতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাত্র সাড়ে সাত বছরের মাথায় সফলতার মুখ দেখতে পেয়েছি। আর চাকরির প্রতি কোনদিনই তেমন আগ্রহ ছিলনা। এলাকাতে এসেও অনেককে দেখি কাজকর্ম ছাড়াই ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিষয়টি আমাকে নাড়া দেয়। প্রথম যখন মাছ চাষ শুরু করি, এলাকার অনেকে বলত, মাছ চাষই যদি করতে হবে, এত পড়াশোনা করে কী লাভ হলো। প্রথম প্রথম পরিবারেরও কেউ বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি। তবে কিছুদিন পরই বড় ভাইকে পাশে পেয়েছি। তিনি আমাকে সাহস দিয়েছেন আমার পাশে থেকেছেন। তাই এতদূরে আসতে পেরেছি। উদ্যোক্তা হতে গেলে পরিবারের সার্পোর্ট সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে।

শুরুতে একটি পুকুরে পোনা উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হলেও বর্তমানে নিজস্ব জমিতে ছোট–বড় ৯টি পুকুর ও ইজারা নেওয়া ৪টি পুকুরে মাছ চাষ করছেন। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪ হেক্টর পুকুরে কার্প–জাতীয় রুই মাছ, শিং, পাবদা, গুলশা ও টেংরা মাছের মোট ৪৬ লাখ পোনা উৎপাদন করেছেন।

পড়তে পারেন: মাছ চাষে কোটিপতি রাজশাহীর সোহরাব

এ সময় ৫৫ লাখ ৩৮ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে বছর শেষে পেয়েছেন ৮৭ লাখ ৭ হাজার টাকা। গত অর্থবছরে দিনাজপুরের পার্বতীপুর মৎস্য বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে জেলার সর্বোচ্চ রেণু সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাজ অ্যাগ্রো ফার্মকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ফার্মটি দিনাজপুরের পোনা ও মাছের চাহিদা মিটিয়ে পার্শ্ববর্তী রংপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলাতেও পোনা সরবরাহ করছে।

বিরামপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা কাউসার হোসেন তাজ অ্যাগ্রো ফার্ম সম্পর্কে বলেন, এই ফার্মে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে রেণু থেকে পোনা উৎপাদন কর হয়। রোগমুক্ত ও গুণগত মান উন্নত হওয়ায় মৎস্য খামারিদের কাছে এসব পোনার বেশ গ্রহণযোগ্যতা আছে।

আবু সালেহ তারেক দেশের মধ্যে প্রথম কম বয়সী তরুণ মৎস্য উদ্যোক্তা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক স্বর্ণপদক পেয়েছেন। বিভিন্ন মানদণ্ড যেমন হেক্টরপ্রতি ৭ লাখ পোনা উৎপাদন, খামারের আয়–ব্যয়ের হিসাব, সরকারি রাজস্ব প্রদান, নারীদের কর্মসংস্থানসহ সব শর্ত পূরণ সাপেক্ষে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক এ সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। এছাড়া উপজেলায় ২ হাজার ২০০টি পুকুরে ১ হাজার ৬০০ মাছচাষি রয়েছেন।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ