নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী: রাজশাহীর তানোর পৌর এলাকার ৪ নাম্বার ওয়ার্ডের গুবিরপাড়া এলাকার মো: সোহেল রানা (৪৩)। ২০০২-৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল সায়েন্স থেকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে চাকরি নেন বেসরকারি এনজিওতে। চাকরি করেন প্রায় ১৭ বছর। এরপর ফিরে আসেন মাটি ও মানুষের কাছে। শুরু করেন কৃষিকাজ। সর্বশেষ বছর দুয়েক আগে লেয়ার মুরগিতে বিনিয়োগ করেন এই উচ্চশিক্ষিত যুবক। এখন ডিম দেওয়া সাদা লেয়ারে বাজিমাত করেছেন সোহেল।

গত ৯ সেপ্টেম্বর সরেজমিনে তাঁর খামারে গিয়ে দেখা যায়, ডিম সংগ্রহ করছেন সোহেল রানা। বাইরে এসে জানালেন-তাঁর খামারে আছে ১১০০টি লেয়ার সাদা মুরগি। ৯০ শতাংশের উপরে ডিম পাচ্ছেন। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে চার্জার ভ্যান। ভ্যানচালক একটি একটি ডিমের পাতা সাজিয়ে নিচ্ছেন। সেদিন ডিমের পাইকারি বাজার ছিল সাড়ে আট টাকা। সফলতার পেছনের কৌশল নিয়ে কথা হয় এই উদ্যোক্তা সাথে।

তিনি অকোপটে জানান, বাবা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার মো: লোকমান হাকিম সন্তানদের সুশিক্ষিত করতে বেশ সচেষ্ট ছিলেন। দুই ভাইবোনের মধ্যে বড়ভাই ব্যবসা করেন। বোনদের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে অনেক আগেই। সোহেল রানা নিজে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে নেমে পড়েন। সালটা ২০২১ এর শেষের দিকে। ভরপুর করোনাকাল। বৈশি^ক অর্থনীতির টালমাটাল পরিস্থিতিতেই সাহসে করেন বিনিয়োগ। আগের কর্মস্থলের বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করে পরামর্শ নেন। সবার মতামতের সাথে না মিললেও নিজের সিদ্ধান্তকেই বাস্তবায়ন করতে নেমে পড়েন। মুরগি সুস্থ রাখতে ও ঘরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই পরামর্শ বেশ কয়েকজন দিয়েছিলেন তাঁকে।

এগ্রিকেয়ার২৪.কমের আরোও নিউজ পড়তে পারেন:

চাকরি ছেড়ে লেয়ার মুরগিতে বাজিমাত ইরাক ফেরত ফারুকের

শীতকালে লেয়ার গ্রোয়ার পালনে সতর্কতা ও নিয়মাবলী; পর্ব ১

শীতের সময়ে লেয়ার গ্রোয়ার পালনে ভ্যাক্সিন সিডিউল; পর্ব-৩

শীতের সময়ে লেয়ার পালনে দৈহিক ওজন ব্যবস্থাপনা- ৫ম পর্ব

খামারি সোহেল রানা বলেন, রাজশাহীতে ৩৭ থেকে ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা বেশিরভাগ সময়ই ছিল। গরমের সময় তাপমাত্রা অত্যন্ত বেড়ে যায়। ফলে মুরগি হিট স্ট্রোক, রক্ত আমাশয়, সর্দিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। মূলত এসব রোগ তাপমাত্রা উঠানামা ও তাপ নিয়ন্ত্রণ না থাকলে হয়ে থাকে। মুরগির ডিমের ক্ষেত্রে যদি আপনি ৯৫ শতাংশ ডিম পেয়ে থাকেন তাহলে আপনি বেশ ভালো অবস্থানে থাকবেন। এখন ডিমের দাম বাড়ানোর দরকার। কারণ মুরগির ডিমের পার্সেন্ট কমে ৮০ থেকে ৮৫’তে নেমেছে। বিভিন্ন খামারির মুরগি মারা যাচ্ছে।

খামারে সিমেন্ট শীট ব্যবহারের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাধারণ টিন/স্টিল ব্যবহারে খামারের তাপ কয়েকগুণ বেড়ে যায় কিন্তু আনোয়ার সিমেন্ট শীটের কারণে খামারে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। তাছাড়া আশেপাশে আমের গাছ থাকার কারনে পাতা পড়ে লোহার টিন মরিচা ধরতে পারে। সিমেন্টের টিন মরিচা ধরার কোন বালাই নাই।

ডিমের দামে লাভবান হতে পারছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমানে ডিমের দামে খুববেশি লাভ হচ্ছে না। ৮ টাকা খরচ করে একটা ডিম উৎপাদন করে সাড়ে আট টাকায় বিক্রি করে লাভ নেই। তবে লাভ হবে এটা বলা যায়। বিশেষ করে খামারে যদি অসুখ বিসুখের পরিমাণ কম হয় আর মুরগি যদি মারা না যায় তাহলে আপনি সফল হবেন।

বর্তমানে ডিমে কিংবা মুরগিতে লাভবান হতে গেলে কি করণীয় রয়েছে। এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, স্থানীয় উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে গড়ে উঠেছে পোল্ট্রি খাদ্যের ডিলার। তারা খামারিদের অর্ধেক টাকা বাঁকিতে খাদ্য ও একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা সরবরাহ করে থাকে। খামারিরা সেই বাচ্চা কয়েকমাস পালনের পর বিক্রয় উপযোগী হলে ডিলার মুরগি বিক্রি করে দেয়। এতে যা লাভ আসে তা খামারিকে দেয় ডিলার।

তবে, শর্ত; নির্দিষ্ট ডিলার ছাড়া খাদ্য, ভ্যাকসিন ও খামারের প্রয়োজনীয় পণ্য অন্য কোথাও কিনতে পারবেন না তারা। ফলে, সরকারি পর্যায়ে বস্তাপ্রতি ৩০ টাকা বাড়লে সিন্ডিকেট বাড়ায় ৭৫ থেকে ৯০ টাকা। আর খামারের উৎপাদিত ডিম ঐ ডিলারকেই দিতে হবে। ডিলার যেই দাম ঠিক করুক না কেন সেই দামেই খামারি দিতে বাধ্য। ফলে লোকসান দিয়েই ডিম বিক্রি করেন খামারিরা। কিছু করার থাকে না।

পোল্ট্রি সেক্টরে সিন্ডিকেটের বিষয়ে তিনি বলেন, বাঁকি হওয়ায় খামারি পর্যায়ে খাদ্যের প্রতি বস্তায় বাড়ে ১০০ থেকে ২০০ টাকা। শুরুতেই ভ্যাকসিনের দাম ও পরিমাণভেদে কয়েক’শ টাকা এবং খামার তৈরির উপকরণে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা লাভ তুলে নেয় ডিলার। এছাড়া কোম্পানির এজেন্ট অথবা অ-রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারি চিকিৎসক অপ্রয়োজনীয় ঔষুধ ব্যবহারে খামারিদের পকেট কাটে কৌশলে। ডিলারদের সাথে একটা শতাংশ চুক্তিতে খামারি ধরার মিশনে নামে কিছু দালাল। আমি ওসবের মধ্যে নাই।

তানোর উপজেলা উপ-সহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (প্রাণী স্বাস্থ্য) মো: রমজান আলী এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, পুরাতন কিছু খামারি তারা ডিম-মুরগির দাম বাড়ার কারণে আবার উৎপাদনে নেমেছেন। আগের তুলনায় রোগবালাই নিয়ে খামারিরা সচেতন তাই লাভবানও হতে পারছেন।

খামারে আনোয়ার সিমেন্ট শীট ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আবহাওয়া পরিবর্তন কিংবা গরমের সময় অত্যন্ত গরম পড়ে। এখন খামারে সিমেন্টের শীট ব্যবহার হচ্ছে। উপরের রোদের তাপের কারণে সাধারন টিন গরম হয়ে নিচে পর্যন্ত তাপ চলে আসে। ফলে খামারের গরু, মুরগি বা হাঁসের সমস্যা হয়ে যায়। কিন্তু সিমেন্টের শীট ব্যবহারের ফলে উপরের তাপ নিচে আসে না। শীতল হয়ে থাকে। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ খামারের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় যাতে খামারের লাভ লোকসান নির্ভর করে। আমরা সিমেন্টের শীটের বিষয়েই বলি।