মেহেদী হাসান, রাজশাহী, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: সিন্ডিকেটের দখলে রাজশাহীর চালের বাজার। রাজশাহী অঞ্চলের ৮ জেলার চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে অটো রাইস মিল মালিক ও মজুদদারদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট বলে জানা গেছে।

এছাড়া ক্রেতা ও বিক্রেতারা বলছেন গত দুই সপ্তাহে ৫০ কেজির প্রতিবস্তা চিকন ও মাঝারি মানের চালের দাম বেড়েছে দেড়’শ থেকে দুই’শ টাকা ।

এই শক্তিশালী সিন্ডিকেট সরকারের বোরো ধান সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হতে দেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। চলতি বছরের গত আগস্ট মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে সরকারি গুদামের জন্য বোরো ধান সংগ্রহ শেষ করার করা ছিল খাদ্য অধিদপ্তরের। কিন্তু এ সময়ে (৩১ আগস্ট) পর্যন্ত রাজশাহী অঞ্চলে সরকারি বোরো সংগ্রহ হয়েছিল লক্ষ্যমাত্রার এক-তৃতীয়াংশের কম।

এ অঞ্চলের ৮ টি জেলা ( রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া,জয়পুহাট, পাবনা) থেকে ধান সংগ্রহ করা হয়। সরকারের নির্ধারিত দামের চেয়ে খোলা বাজারে কৃষকদের কাছে থেকে বেশি দামে ধান কিনে নেয় অটো রাইস মিল মালিক ও শতাধিক মজুদ ব্যবসায়ীরা। বোরো মৌসুমে লাখ লাখ মণ ধান মজুদ করে বাজার নিজেদের আয়ত্তে করে এই সিন্ডিকেট। এখন তারা নিজেদের ইচ্ছামতো চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে বলে অসংখ্য অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে।

উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার প্রায় ২০০ অটো রাইস মিল মালিক ও শতাধিক মজুদ ব্যবসায়ী বাজার রেখেছে নিজের দখলে। পাইকারি চাল ব্যবসায়ী ও খুরচা বিক্রেতাদের অভিযোগ বাজার নিয়মিত মনিটরিং না থাকায় এই চক্রটি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। নিজেদের কাছে জনগণকে জিম্মি করছে।

গণমাধ্যমের প্রকাশিত তথ্য এবং রাজশাহী ও রংপুর কৃষি অধিদফতর সূত্র অনুযায়ী, রাজশাহী বিভাগে মোট আবাদযোগ্য কৃষি জমির পরিমাণ ১৪ লাখ ১৮ হাজার ৩৯০ হেক্টর এবং প্রতিবছর চালের চাহিদা ২৯ লাখ ২৬ হাজার ৬০০ টন। রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলে জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটি ৪০ লাখ। এসব মানুষের প্রতি বছর খাদ্যের চাহিদা হচ্ছে ৫৮ লাখ দুই হাজার ১১ টন। গত মৌসুমে আমন, আউশ, গম ও বোরো ফসলের উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ৭২ লাখ ৪৫ হাজার ২৫৪ টন।

এ অঞ্চলে মোট উৎপাদন চাহিদার এক কোটি পাঁচ লাখ ৮০ হাজার ৭১০ টন বেশি খাদ্য উৎপাদন হয়েছে। একজন মানুষ গড়ে প্রতিদিন ৫৫৩ দশমিক ৬ গ্রাম খাদ্য গ্রহণ করতে পারে। এর মধ্যে ১১ শতাংশ রয়েছে শিশু, বৃদ্ধ ও খাদ্য গ্রহণে অনুপযোগী। ফলে খাদ্য গ্রহণকারীর সংখ্যা তিন কোটির সামান্য বেশি হয়। উৎপাদন বেড়েছে কিন্তু চালের দাম হুহুকরে বেড়েই চলেছে।

রাজশাহীর নওগাঁ, নাটোর, তানোর, চাঁপাইনবাগঞ্জসহ জেলার অন্যান্য বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মানভেদে স্বর্ণা ৫০ কেজির বস্তা এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে দুই হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার ৩০০ টাকায় কিন্তু বর্তমানে বস্তাপ্রতি ২০০ টাকা বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা। এছাড়া কাটারিভোগ সিদ্ধ তিন হাজার ৮০০ থেকে চার হাজার টাকায় ও কালিজিরা চাল চার হাজার ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকা, আঠাশ চাল দুই হাজার ৩০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকায়, মিনিকেট দুই হাজার ৬০০ থেকে দুই হাজার ৭৫০ টাকায়, বাসমতি দুই হাজার ৯০০ থেকে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে

খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সরকারের শিথীলতা নীতি ও তড়িত ব্যবস্থা এখনই না নেওয়া হলে জনগণকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হবে। ধান-চাল মজুদদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠবে। সিন্ডিকেটটি চালের বাজার অস্থিতিশীল করে তুলবে কখন বলা যাবে না।

আরোও পড়ুন: নওগাঁয় ফের অস্থির চালের বাজার

চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে প্রয়োজনে শুল্ক কমিয়ে চাল আমদানি

রাজশাহীর পাইকারি এক চাল বিক্রেতা এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে জানান, চালের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে আড়ৎ ধানের দাম বাড়াকে দায়ী করছেন। বাজারে প্রতিমন ( ৪০ কেজি) আটাশ ধান এক হাজার ৩০০ টাকা, জিরা এক হাজার ৩৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ধানের দাম বাড়লে চালের দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। তবে, পরিস্থিতি বুঝে মিল মালিকরা ধান এবং চাল মজুদ করেছেন বলে জানান এই ব্যবসায়ী।

চাতাল ও অপেক্ষকৃত ছোট পরিসরে চাল উৎপাদনকারীরা বলছেন, চালের দাম বাড়লে যাদের লাখ লাখ টন ধান-চাল মজুদ করার ক্ষমতা আছে তাদের লাভ হবে। চাতালের তেমন কোন লাভ নেই। বরং অটো রাইস মিলের দাপটে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না বলেও অভিযোগ চাতাল মালিকদের।

নওগাঁর কয়েকজন মিল চাতাল মালিক ও আড়তদার জানান, মৌসুমের শুরু থেকেই ধানের দাম বেশি। প্রথম থেকেই অটো রাইস মিলগুলো উল্লেখযোগ্য ধান সংগ্রহ করেছে । অটো রাইস মিল মালিকরা অনেকবেশি ধান সংগ্রহ করে নিজেদের ইচ্ছামতো চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। ছোট ব্যবসায়ীরা বড় ব্যবসায়ীদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেওে অনেকে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে।

প্রান্তিক কৃষকের কাছে ধানের কোন মজুদ নেই। মৌসুমের শুরুতেই মজুদদাররা ধান-চাল মজুদ করে রাখে। তারাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এসব সিন্ডিকেট ও মজুদদাররা সুযোগ পেলেই দাম বাড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে ধান-চালের দাম বাড়লেও সেই টাকা চলে যায় তাদের পকেটে। কৃষকরা এই টাকার কোন সুফল ভোগ করতে পারেন না।

নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা এগ্রিকেয়ার২৪.কম কে বলেন, অটো রাইস মিল মালিকরা ধানের মজুদ গড়ে তুলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। সারাদেশে কয়েক হাজার চাল কল আছে। নওগাঁতে আছে ১২০০ চালকল, তার মধ্যে ৫৩ টি অটো রাইস মিল। আমরা ইচ্ছা করলেই তো আর দাম বাড়াতে পারিনা। সরকার ২৬ টাকা দরে ধানের দাম বেঁধে দেওয়ায় কৃষকরা কম দামে সরকারি গুদামে ধান দেয়নি। শুরু থেকেই ধানের বাজার বেশি। তাই কৃষকের কাছে থেকে আমরা বেশি দামেই কিনেছি। ধান বেশি দামে কেনা থাকলে চাল কমদামে বিক্রি হবে এটা হয়না।

ধান-চাল মজুদ ও অটো রাইস মিলগুলোর দৌরাত্ম্যে ছোট ছোট মিল চাতাল মালিকরা ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে এমন অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক এগ্রিকেয়ার ২৪.কম কে বলেন, আমরা ব্যবসা করি সরকারের বেঁধে দেওয়া নীতিমালা অনুযায়ী। আমরা যদি নীতিমালার বাইরে গিয়ে মজুদ করে থাকি তাহলে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। অহেতুক গালিগালাজ করা হয় আমাদের। মুনাফাখোর, মজুদদার বলা হয়।
নওগাঁতে ১২০০ চালকল আছে। ৫৩ টি অটো রাইস মিল। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যদি তাদের ক্যাপসিটি অনুযায়ী ব্যবসা করতে না পারেন তাহলে আমাদের করার কিছুই নেই। দু-একজনের সমস্যা হতে পারে।

অটো রাইস মিল মালিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, কোথাও বেশি ধান-চাল মজুদ করা থাকলে সরকারিভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হোক এটা আমরাও চাই। তবে, সবসময় সবার গুদামে দিয়ে খোঁজ নেওয়া সম্ভব হয় না। মজুদদার থাকতে পারে হাতেগোনা দু-একজন ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সিন্ডিকেটের দখলে রাজশাহীর চালের বাজার। এ অবস্থা বেশ কয়েক বছর ধরে চললেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। চলতি সেপ্টেম্বর মাসে খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার মজুদদারদের হুঁশিয়ারি করে বলেছেন, অবৈধ মজুদদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কথা সর্বস্ব না হয়ে সরকার ও জনগণ একত্রে সিন্ডিকেট রুখতে ভূমিকা রাখতে হবে।

 

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ