মো. আবদুল মানিক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: আম ফলের রাজা। একটি উৎকৃষ্ট সুস্বাদু ফল হিসেবে আমের বাণিজ্যিক গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের প্রায় সব কটি জেলাতেই কমবেশি আম উৎপাদন হয়। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে আম শিল্পের যেমন সম্ভাবনা রয়েছে তেমনি সমস্যাও রয়েছে।

সারা দেশে উল্লিখিত পরিমাণ আম উৎপন্ন হয় প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার একর জমিতে। সুতরাং এত বিপুল পরিমাণ জমিতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জনশক্তি সম্পৃক্ত থাকে। বাগান চাষ ও পরিচর্যার জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিক ছাড়াও শুধু ফলনের মৌসুমেই অর্থাৎ বছরের প্রায় ৪/৫ মাস প্রচুর লোক সারা দেশে আম সংক্রান্ত কর্মকা-ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকে। নিম্নোক্তভাবে এক্ষেত্রে জনশক্তির কর্মসংস্থান হতে পারে।

পড়তে পারেন: বৃষ্টিতে খুশি আম চাষিরা, শঙ্কায় সবজি

১. আম চাষ ও পরিচর্যার মাধ্যমে
২. সংগ্রহ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে
৩. আম ও আমজাত দ্রব্যাদি পরিবহনের মাধ্যমে
৪. আম ও আমজাত দ্রব্যাদি বাজারজাতকরণের মাধ্যমে
৫. আম শিল্প

১. আম চাষ ও পরিচর্যার মাধ্যমে
ভালো ফলনের জন্য আম গাছে পরিকল্পনা- মাফিক পরিচর্যার প্রয়োজন হয়। আমের মুকুল আসা থেকে শুরু করে পূর্ণতা অর্থাৎ আম গাছের সঠিক পরিচর্যা ঠিকমতো না হলে ফলনের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয় না। মুকুল আসার আগে ও পরে সার প্রয়োগ, সেচ এবং ‘স্মার্জিং স্প্রে’ আমের ফলনের জন্য নার্সারি পরিচর্যা হিসেবে পরিগণিত। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় প্রতি বছর কমপক্ষে ৪/৫ মাস আম বাগান পরিচর্যার জন্য প্রতি তিন একর আয়তন বিশিষ্ট আম বাগানে ৫ জন শ্রমিক কর্মরত থাকেন। সেই হিসাবে বর্তমানে দেশে ১,২০,০০০ একর জমিতে ৪/৫ মাসের জন্য ১.৬ লাখ থেকে ২ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আম চাষের ক্ষেত্রেই কেবল এটি ঘটে থাকে।

পড়তে পারেন: পুঠিয়ায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে কাটিমন আম

২. সংগ্রহ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে
আম শিল্পে সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য বিপুল লোক কর্মরত আছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আম বাগানগুলোতে প্রতি দশ একর জমিতে আমের পূর্ণতা প্রাপ্তির পর অর্থাৎ পাকার সময় গড়ে ৬/৭ জন লোক একমাস শ্রম দিয়ে থাকেন। এই হিসাবে প্রতিবছর ৭২-৮৪ হাজার লোকের এক মাসের কর্মসংস্থান হয়। সংরক্ষণের জন্য আমের হিমাগার নির্মাণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হলে আলুর হিমাগারের মতো অনেক লোকের কর্মসংস্থান ঘটবে।

৩. আম ও আমজাত দ্রব্যাদি পরিবহনের মাধ্যমে
সত্যিকার অর্থে, যে কোনো কাঁচামালের উপযুক্ত দাম এবং উপযোগ পেতে হলে পরিবহনের বিষয়টি সর্বাগ্রে গুরুত্বের দাবি রাখে। আম ফলের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটে না। সুতরাং কিছুসংখ্যক লোককে পরিবহনের কাজে সবসময়ই ব্যস্ত থাকতে হয়। আম উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে সারা দেশে তা বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে পরিবহন করতে হয়। যেমন- সড়ক পথে ট্রাক, রেল, ভ্যান গাড়ি, গরুর গাড়ি, ঘোড়া গাড়ি ইত্যাদি। পানি পথে নৌকা, স্টিমার, ফেরি, লঞ্চ ইত্যাদি এবং রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিমান। এসব মাধ্যমে পরিবহনের জন্য উল্লেখযোগ্য জনশক্তি কর্মরত থাকে।

পড়তে পারেন: আমের নতুন রাজধানী নওগাঁ

চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে আমের মৌসুমে (জুন-জুলাই) দুই মাস প্রতিদিন শত শত ট্রাকে হাজার হাজার টন আম রপ্তানি করা হয়ে থাকে। এভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে যে পরিমাণ আম পরিবাহিত হয়, তাতে সব মিলিয়ে সারাদেশে শুধু পরিবহনের জন্য কয়েক হাজার লোককে লাগাতার শ্রম দিতে হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, ক্ষুদ্র পরিসরেও আমজাত পণ্য পরিবহনে কিছু লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে।

৪. আম ও আমজাত পণ্য বাজারজাতকরণের মাধ্যমে
মৌসুমি ফল হিসেবে আমাদের দেশে যে পরিমাণ আম উৎপাদিত হয়, তা বাজারজাতকরণে যে পরিমাণ লোকের কর্মসংস্থান হয় সেটা নেহায়েত কম নয়। তবে বছরের সীমিত সময় দুই থেকে আড়াই মাস আমের বিপণন প্রক্রিয়া চলে বলে এতে খুব বেশি সংখ্যক জনশক্তি কমংসংস্থানের সুযোগ থাকে না। এক্ষেত্রে আমের প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে যদি সঠিকভাবে উচ্চমানের বাজারজাত করা সম্ভব হয় তাহলে প্রচুর লোকের কর্মসংস্থান হতে পারে।

পড়তে পারেন: একনজরে আম চাষ ব্যবস্থাপনা

৫. আম শিল্প
আম কৃষি পণ্য হলেও একে শিল্প পণ্যে রূপান্তরের মাধ্যমে তথা আম শিল্প গড়ে তোলার জন্য যেসব উপকরণের দরকার, তা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোনো সমস্যা নয়, বরং সমস্যা হলো উদ্যোগের। প্রাণ কোম্পানির মতো আমজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করতে পারলে বিপুল সংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান ঘটবে এই শিল্পে- তাতে সন্দেহ নেই।

খ. অর্থনৈতিক উন্নয়নে আমের অবদান
অর্থনৈতিক দিক থেকে আমের অবদান কোনো অংশে কম নয়, আন্তর্জাতিক মানের এই ফলটি শুধু পুষ্টি ও স্বাদের জন্যই বিখ্যাত নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইতোমধ্যে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে ফিলিপাইন ও ভারতে। ফিলিপাইন ‘স্পার্জিং’ পদ্ধতিতে বছরের অধিকাংশ সময় আম উৎপাদন করে এবং নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে থাকে। ভারতও একইভাবে আমি রপ্তানি করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের অবস্থা উল্টো। এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত আমরা আমকে অর্থনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। আম ও আমজাত সামগ্রী বিভিন্নভাবে বাণিজ্যিক পণ্য হতে পারে।

পড়তে পারেন: ধানের রাজ্যে খাটো গাছে আমের রাজত্ব

১. রপ্তানি পণ্য হিসেবে আম বিদেশে রপ্তানি করার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

২. আমকে প্রক্রিয়াজাত করে শিল্প পণ্যে রূপান্তরের মাধ্যমে বড় ধরনের বাজার সৃষ্টি করা যায়। দেশে-বিদেশে এসব পণ্যের চাহিদা সৃষ্টির মাধ্যমে বাজারজাত ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে পারলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে।

৩. আম গাছের কাঠ বড় ধরনের অর্থকরী সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। জ্বালানির ওপর উত্তরাঞ্চলের প্রায় দুই কোটি লোক নির্ভরশীল, বর্তমানে আম কাঠের জ্বালানি বিপুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, সাথে সাথে দেশের জনগোষ্ঠীর আসবাবপত্রের চাহিদা পূরণে আম কাঠ বিরাট ভূমিকা রাখছে।

৪. আম অধিকাংশ ফলের চেয়ে অধিক মূল্যবান। প্রতিষ্ঠিত আম বাগান এক ধরনের স্থাবর সম্পত্তির মতো। এ সম্পত্তি থেকে বছরে নিয়মিত আয় হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় এক একর আম গাছ থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে এক লাখ টাকা উপার্জন করা সম্ভব।

ফলের রাজা ‘আম’ এবং আবাল বৃদ্ধ বনিতা সবার প্রিয় ফল ‘আম’ এর অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে অন্যান্য শিল্পের মতো অগ্রাধিকার প্রদান করে সঠিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে আম শিল্পের বিকাশে এখনই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এই শিল্পে নানাবিধ সমস্যা ও সম্ভাবনাকে গবেষণার মাধ্যমে তুলে ধরে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে আম শিল্পের সমস্যা ও সম্ভাবনা লিখেছেন বগুড়া সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামাজিক প্রতিবন্ধী মেয়েদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মো. আবদুল মানিক।

 

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ