মালিকুজ্জামান কাকা, যশোর প্রতিনিধি: কেশবপুরে বাণিজ্যিক ড্রাগন চাষে সফলতা পেয়েছেন সাইফুল ইসলাম। তাঁর বাগানে ড্রাগন চারা রোপণের ৮-৯ মাসে ফল ধরেছে। রোপনের পর অল্পদিনে উৎপাদন ও অধিক লাভজনক হওয়ায় কেশবপুরসহ পাশর্^বর্তী উপজেলার কৃষক ও ব্যবসায়ীরা ড্রাগন চাষ করছেন। শুরুতে মাত্র ৪ বিঘা জমিতে সাইফুল ৫ লক্ষ টাকার ড্রাগন ফল বিক্রি করেন।

গাছের বয়স যত বৃদ্ধি পাবে ফলন তত বাড়বে। আগামী ১০ বছরে কোটি টাকার বেশি উৎপাদন হবে। যশোরের কেশবপুর উপজেলার সাতবাড়িয়া গ্রামের সফল চাষী সাইফুল ইসলাম। সাতবাড়িয়া গ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম আতিয়ার রহমানের ছেলে সাইফুল ইসলাম পরিকল্পনা নেন ড্রাগন ও সৌদি খেজুরের আবাদের। তিনি গড়ে তুলেছেন ড্রাগন ও সৌদি খেজুর বাগান। খেজুর, ড্রাগনের সাথে মিশ্র ফসল হিসেবে বেগুন, ঝাল, ওল ও চাল কুমড়ার আবাদ রয়েছে। তার এ আধুনিক প্রযুক্তির আবাদ সম্প্রসারণে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন।

পড়তে পারেন: ছাদ বাগানে টবে চাষ করুন ড্রাগন ফল

সাধারণত ড্রাগন গাছ রোপনের ১২-১৮ মাসে ফল ধরে। এ প্রজাতির গাছ প্রায় ১০০ বছর বাঁচে। ৫০-৬০ বছর পর্যন্ত ভালো ফল উৎপাদন হয়। ২০/২৫ বছর আশাপ্রদ ফলন হয়, পরে উৎপাদন কমতে থাকে। পাশের কলারোয়া উপজেলার কওসার আলী সাইফুলের বাগান থেকে গাছের কান্ড সংগ্রহ ও তার পরামর্শে ১১ বিঘা জমিতে চাষ শুরু করেছেন।

এছাড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ছোট-বড় কৃষক ও ব্যবসায়ীরা সাইফুলের পরামর্শে ড্রাগন চাষে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। সাতবাড়িয়া গ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান মৃত আতিয়ার রহমানের ছেলে সাইফুল ইসলাম যশোরের পলাশী-রুদ্রপুর পার্কের পাশে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সালাহউদ্দীন মিয়াজীর ড্রাগন চাষ দেখে উদ্বুদ্ধ হন।

পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইউটিউব দেখে ড্রাগন চাষ শেখেন। ঐ বছর সামরিক কর্মকর্তার বাগান থেকে ড্রাগন কান্ড সংগ্রহ করে ৪ বিঘা জমিতে রোপন করে। ২৫০০ সিমেন্ট পিলার সোজা করে মাটিতে পুঁতে তার উপর পুরাতন টায়ার বেঁধে চাষ ও নিয়মিত পরিচর্যা শুরু করেন। ৪ বিঘা জমিতে ড্রাগন চাষে খরচ হয় প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা। এছাড়া তিনি সৌদি খেজুর, লটকন, মাল্টা, থাই নারকেল, আম ও সিডলেস লেবু চাষ করছেন।

পড়তে পারেন: ১ বিঘা জমিতে ১৩ লাখ টাকার ড্রাগন বিক্রি!

সাইফুলের বাগান সার্বক্ষণিক দেখাশুনা করেন মালী শহিদুল ইসলাম। প্রায় ২৩ বছর ধরে তিনি সাইফুলের বিভিন্ন ফল ফলাদির বাগান দেখাশুনা করেন। তিনি জানান, ড্রাগন গাছ রোপনের পর ১২-১৮ মাস সময় লাগে ফল আসতে। কিন্তু তাদের বাগানে ফল এসেছে ৮-৯ মাসে। বছরে প্রায় ১০ মাস ফল ধরে। এক রোপনে প্রায় ১০০ বছর বেঁচে থাকে গাছ। তবে ৫০ বছর পর্যন্ত ভাল ফলন পাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে ১২-১৮ মাস বয়সী ১টি গাছে ৫-২০টি ফল, ৫-৬ বছর পর ১টি গাছে ২৫-১০০ ফল উৎপাদন হয়।

সুস্বাদু ও বিভিন্ন রোগে উপকার হয় বলে বর্তমানে ড্রাগন ফলের ব্যাপক চাহিদা। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা ফল ক্রয়ে অগ্রীম অর্ডার করেন। বাগানে প্রতি কেজি ২০০-৩৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়। ৮-৯ মাসে বিঘা প্রতি প্রায় ১৫০ মন ফল হয়েছে। অতিবৃষ্টি না হলে ৪ বিঘা জমিতে বছরে ৬০০ মন ফল পাওয়া যায়। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রতিমন ১০০০০ হিসেবে ৬০ লক্ষ টাকা।

পড়তে পারেন: জনপ্রিয় লাল ড্রাগন চাষে অধিক লাভ, এক বছরেই ফলন

ড্রাগনের জন্ম মধ্য আমেরিকায়। মালেশিয়ায় এর উৎপাদন শুরু বিংশ শতাব্দীতে। ভিয়েতনামে বেশি চাষ হচ্ছে। এছাড়া তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, মালেশিয়া, চীন, ইসরাইল, অস্ট্রেলিয়ায় চাষ হচ্ছে। ২০০৭ সালে বাকৃবি’র জার্ম প্লাজম সেন্টার প্রফেসর ড. এম এ রহিম গবেষণায় ড্রাগন কয়েক জাত আনেন থাইল্যান্ড থেকে। ঐ প্রথম এ দেশে ড্রাগন গাছ আসে। তাঁর গবেষণা সফল হয়।

সেসব গাছে ফলন আসে। এ সফলতায় গবেষণা সেন্টার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ড্রাগন ফলের উন্নত জাতের চারা সরবরাহ করছে। ড্রাগনফল ২ প্রকার টক ও মিষ্টি স্বাদের। মিষ্টি স্বাদের ড্রাগন ফলের আবার ৩ জাত। লাল ড্রাগনফল বা পিটাইয়া। এ প্রজাতির ফলের খোসার রঙ লাল, শাঁস সাদা। এ দেশে এ প্রজাতি চাষ বেশি। কোস্টারিকা ড্রাগন ফল: এ ফলের খোসা ও শাঁসের রঙ লাল। হলুদ ড্রাগন ফল: এ ফলের খোসা হলুদ রঙের ও শাঁসের রঙ সাদা। ড্রাগন ফলের চারা তৈরি খুব সহজ। বীজ দিয়ে চারা তৈরি হয়।

পড়তে পারেন: ড্রাগন গাছে অভিনব কৌশল, বোঝানো হচ্ছে ১৮ ঘণ্টায় দিন!

তবে এ চারায় ফল ধরতে অনেক সময় লাগে। তাই কাটিং পদ্ধতিতে শাখা কলম করে চারা তৈরি উত্তম। বয়স্ক ও শক্ত শাখা (এক-দেড় ফুট লম্বা) কোনাকুনি কেটে বালি বা বেলে দো-আঁশ মাটিতে রোপনে ২০-৩০ দিনে শিকড় গজায়। কাটিং সাধারণত মরে না। কাটিং উৎপাদিত গাছে ১-দেড় বছরে ফল ধরে। রোপনের আগে জমি ভালোভাবে চাষ দিয়ে সমান করে তিন মিটার পরপর সব দিকে সারি করে ড্রাগন চারা লাগানো হয়।

চারা রোপনের ১ মাস আগে গর্ত তৈরি করে তা সারমাটি দিয়ে ভরে রেখে দিতে হয়। প্রতি গর্তে ৪০ কেজি পচা গোবর, ৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম করে টিএসপি ও এমওপি সার, ১০ গ্রাম করে জিপসাম, জিঙ্ক সালফেট ও বোরাক্স সার দেয়া হয়। যে কোনো সময় চারা লাগানো যায়। তবে এপ্রিল-সেপ্টেম্বরে ভালো হয়। প্রতি গর্তে ৪/৫ চারা লাগাতে হয়। সিমেন্ট বা বাঁশের খুঁটির সাথে গাছ বেঁধে দিতে হয়।

পড়তে পারেন: নিয়ামতপুরে ড্রাগন চাষে সফল কলেজ শিক্ষক জুয়েল

ড্রাগন গাছ প্রায় ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। তখন হলুদ রঙ পরে কালো রঙ ধারণ করে। পরে ওই অংশে পচন শুরু হয়। দ্রুত রোগ দমনে ছত্রাকনাশক, বেভিস্টিন, রিকোমিল, থিওভিট ইত্যাদির যে কোনোটি ২ গ্রাম প্রতি লি. পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগে ভাল ফল হয়। ড্রাগন গাছে ক্ষতিকর প্রায় এফিড ও মিলি বাগ আক্রমণ হয়। এরা গাছের কচি শাখা ও পাতার রস চুষে খায়, ফলে রঙ ফ্যাকাশে হয় ও গাছ দুর্বল হয়।

এ পোকা দমনে সুমিথিয়ন বা ডেসিস বা ম্যালাথিয়ন প্রতি ১০ লি. পানিতে ২৫ মি.লি. মিশিয়ে ¯েপ্র করা হয়। ড্রাগন ক্যাকটাস প্রজাতির গাছ। গাছ লতানো, কোনো পাতা নেই। গাছ ১.৫-২.৫ মি. লম্বা হয়। সবুজ রঙের গাছে সুন্দর সাদা ও সবুজাভ সাদা রঙা ফুল ফোটে। দেখতে অনেকটা ‘নাইট কুইন’ এর মতো। ফুল স্বপরাগায়িত। ফুল বেশ বড়। ড্রাগন ফুলকে বলে ‘মুন ফ্লাওয়ার’ বা ‘নাইট কুইন’।

পড়তে পারেন: নওগাঁয় ড্রাগন চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা, বাড়ছে বাগান

ফুল থেকে ডিম্বাকার ফল হয়। ফলের খোসা নরম। ১টি ফলের ওজন ১৫০-৬০০ গ্রাম। ফলের ওজন ১কেজি পর্যন্ত হয়। পাকা ফলের শাঁস বেশ নরম, কালোজিরার মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কালো রঙা অসংখ্য বীজযুক্ত হালকা মিষ্টি।

এগ্রিকেয়ার/এইএইচ