মেহেদী হাসান, নিজস্ব প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: রাজশাহীতে মিশ্র পদ্ধতিতে গলদা চিংড়ি চাষে অপার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন রাজশাহী মৎস্য অফিসের ফিস সিড ম্যাল্টিপুলেশন ফার্ম ম্যানেজার ড. জিন্নাত আরা রোকেয়া চৌধুরী। মিশ্র পদ্ধতিতে কার্প জাতীয় মাছ চাষ করলেও এখন অনেকটাই চিংড়ি চাষে আগ্রহী হচ্ছে চাষিরা।

জানা যায়, গলদা চিংড়ি মিষ্টি ও স্বাদু পানির মাছ। তবে বাচ্চা ফোটার সময় লোনা পানি লাগে, বাকি সময় মিষ্টি ও স্বাদু পানি হলেই চলে। দেশব্যাপী স্বাদু পানির গলদা চিংড়ির বীজ উৎপাদনক্ষম অবকাঠামো গড়ে তোলার আওতায় ১৯টি ক্ষুদ্র হ্যাচারি ও নার্সারি সংস্কারের মাধ্যমে চিংড়ির বীজ উৎপাদন করার ২০১৭ সালে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরকার।

এর পাশাপাশি ৬১টি জেলায় এ ধরণের চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণে ছয়টি আধুনিক হ্যাচারি ও নার্সারি স্থাপনেরও উদ্যোগ নেয় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে জুন ২০১৮ সালের মধ্যেই ৬২ কোটি ৪৩ লাখ ১৩ হাজার টাকা খরচ করে চিংড়ি চাষ সম্প্রসারিত করার জোর প্রচেষ্টা করা হয় দেশব্যাপী। এরই ধারাবাহিকতায় রাজশাহী, বগুড়া ও নওগাঁ জেলায় গলদার চাষ হচ্ছে।

আরোও পড়ুন: বাগদা ও গলদা চিংড়ির রোগের সাধারণ কিছু লক্ষণ

চিংড়ির রোগের লক্ষণ ও তার প্রতিকার

রাজশাহী জেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় মৎস্য উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৮৩ হাজার মেট্রিকটন। জেলায় মাছের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৫২ হাজার ৬৩ মেট্রিকটন এবং বছরে উদ্বৃত্ত থাকে ২৮ হাজার ৭৮ মেট্রিকটন। ইতোমধ্যেই দেশের মধ্যে তাজা মাছের ক্ষেত্রে রাজশাহী শীর্ষে অবস্থান করছে। একইসাথে যদি সফলভাবে গলদা চিংড়ি উৎপাদন করা যায় তাহলে রাজশাহী অঞ্চল আরও একধাপ এগিয়ে যাবে। অপরদিকে চিংড়ি চাষে লার্ভা উৎপাদন ও তাপমাত্রাকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন মৎস্য অধিদপ্তর।

রাজশাহীতে মিশ্র পদ্ধতিতে গলদা চিংড়ি চাষ কতটা সম্ভাবনাময় জানতে চাইলে ড. জিন্নাত আরা রোকেয়া চৌধুরী এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে আরও জানান, রাজশাহীতে চিংড়ি চাষের ভালো সম্ভাবনা আছে। তবে চিংড়ির লার্ভা উৎপাদন অনেকটাই চ্যালেঞ্জিং বিষয়। লার্ভাকে সহজলভ্য করা গেলে চিংড়ি চাষের মধ্য দিয়ে রাজশাহী আরও একধাপ এগিয়ে যাবে।

এই কর্মকর্তা আরোও জানান, গলদা চিংড়ির ডিম সংগ্রহ থেকে শুরু করে পুরো নার্সিং প্রক্রিয়ায় বায়ো-সুরক্ষা বজায় রাখতে হয়। রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে ডিম থেকে লার্ভা পাওয়া যায়। লার্ভা থেকে পোস্ট লার্ভা পর্যায়ে আসতে ১১টা স্টেপ পার করতে হয়। এ সময় ভারসাম্যযুক্ত খাদ্য, তাপমাত্রা, বায়ুচালনা এবং উপযুক্ত জলের গুণমান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। লার্ভা উৎপাদনে খাবারের ভারসাম্যটাও অত্যন্ত সুক্ষ্মতার সঙ্গে করা হয়। এক্ষেত্রে খাবারের ব্যয়টাও বেশি। এখানে তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হয়। এর কম বা বেশি তাপমাত্রা হলেই লার্ভার মৃত্যু হার বাড়ে।

তিনি আরও জানান, একটি লার্ভা এক টাকা দরে চাষিদের কাছে সরবরাহ করা হয়েছে। দেড় বিঘার মতো জমিতে গলদা হ্যাচারিতে লার্ভা উৎপাদন করা হয়েছে। সেখানে প্রায় এক লাখ লার্ভা উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। ডিম থেকে পোস্ট লার্ভা পর্যায়ে আসতে প্রায় দুই মাস পরিচর্যা করতে হয়। লার্ভা পোস্ট লার্ভায় রূপান্তরিত হলে এটা চাষিদের কাছে সরবরাহ করা হয়। এই লার্ভা তারা মে-জুন মাসের দিকে কৃষকদের সরবরাহ করে থাকেন।

আরোও পড়ুন: সম্পূরক খাদ্যে মাইকোটক্সিন : মাছ বা চিংড়ি চাষের নিরব ঝুঁকি

বাণিজ্যিকভাবে পুকুরে যেসব মাছ চাষ করবেন ও কতটুকু

মার্চ মাস থেকে লার্ভা উৎপাদনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। প্রথম পর্যায়ে পিরোজপুরের পচা নদী থেকে ডিম সংগ্রহ করে ও কক্সবাজার থেকে নোনা পানি সংগ্রহ করে কাজ শুরু হয়। নোনা পানি ছাড়া লার্ভা উৎপাদন সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।

মৎস্য অফিসের ফিস সিড ম্যাল্টিপুলেশন ফার্ম ম্যানেজার আরও জানান, রাজশাহীতে মিশ্র পদ্ধতিতে গলদা চিংড়ি চাষে অপার সম্ভাবনা আছে। তবে লার্ভা উৎপাদন অনেকটাই চ্যালেঞ্জিং। এক্ষেত্রে চাষিদের আগ্রহ আছে। লার্ভা পেলে চাষিরা ভালো করবে। কিন্তু ব্যক্তি উদ্যোগে লার্ভা উৎপাদন বড় চ্যালেঞ্জ হওয়ায় তারা সরকারি উদ্যোগে কাজটি করেছেন। এবছর সফলতাও পেয়েছেন। ভবিষ্যতে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা চান তিনি।

পুকুরে লার্ভার মৃত্যুহার জানতে চাইলে জিন্নাত আরা রোকেয়া চৌধুরী জানান, রাজশাহীতে মিশ্র পদ্ধতিতে গলদা চিংড়ি চাষে সম্ভাবনা থাকলেও শুধু চিংড়ি চাষে তেমন সম্ভাবনা নেই। কারণ মিঠা পানিতে চিংড়ি লার্ভা মৃত্যুহারটা বেশি। পোস্ট লার্ভা পুকুরে ছাড়ার পর পানির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সময়ের প্রয়োজন পড়ে।

রাজশাহীর পবা উপজেলার অন্তর্গত কাঠালবাড়িয়া গ্রামের আবদুস সোবাহান জানান, তিনি গলদা চিংড়ির চাষ করছেন। চাহিদা থাকায় অনেক কৃষক তার থেকে কিশোর চিংড়ি সংগ্রহ করেছেন। ছয় মাসের মধ্যে লার্ভাগুলো ১২০ থেকে ১২৫ গ্রাম হয়ে যায়। স্থানীয় বাজারে এ চিংড়ির ভালো দাম পেয়েছেন তিনি। তবে বাড়তি দামে তাদের লার্ভা সংগ্রহ করতে হয়। তাই রাজশাহীতে লার্ভা উৎপাদন হলে কম দামে তা সংগ্রহ করতে পারবেন এমন আশা প্রকাশ করেন তিনি।

রাজশাহীতে মিশ্র পদ্ধতিতে গলদা চিংড়ি চাষে অপার সম্ভাবনা বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অলক কুমার সাহা এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, রাজশাহীতে গলদা চিংড়ি চাষের সম্ভাবনা আছে। কিছু প্রদর্শনী খামারে কিছু চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে। এছাড়াও এখন অনেক কৃষক চিংড়ি চাষ করছেন। আমরা নিয়মিত চাষিদের পরামর্শ দিচ্ছি। চিংড়ি চাষকে আরও এগিয়ে নিতে মৎস্য অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ