বিশেষ প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: দেশের বিভিন্ন স্থানে চাষিরা দামী ফসলে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। পাহাড়ের ফলগুলো নেমে এসেছে সমতল ভ’মিতে। আলু, পটল, করলা চাষের জমিতে দেদারসে ফলছে দামী ড্রাগন ফল। সামান্য উঁচু জমিতে চাষ হচ্ছে মাল্টা, কমলা, রাম্বুটানসহ বেশ উচ্চমূল্যের ফসল। হটাৎ দামী ড্রাগন ফল, মাল্টা-কমলা চাষে যেসব কারণে ঝুঁকছেন চাষিরা তার বেশ কারণও অনুসন্ধান করা গেছে।

দেশে প্রচুর চাহিদা

দেশে খুচরা পর্যায়ে বছরে ফলের বাজারের আকার প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বলে ধারণা করা হচ্ছে। রাজস্ব বোর্ড ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী করোনার কারণে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ফল আমদানি সামান্য কমেছে। গত পাঁচ অর্থবছরের হিসাবে গড়ে ৬ শতাংশ হারে বাড়ছে বিদেশি ফল আমদানি। তবে দেশীয় ফলের উৎপাদন বাড়ছে ১০-১২ শতাংশ হারে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতির ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক উপাচার্য এম এ সাত্তার মণ্ডল বলেন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। পাশাপাশি সচেতনতা বাড়ায় ফলের চাহিদা বাড়ছে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা ফল আমদানি করে পুষ্টি চাহিদা মেটাতে ভূমিকা রাখছেন। নতুন নতুন বিদেশি ফল আনছেন। এদিকে গবেষকেরাও নজর দিয়েছেন। আবার দেশীয় উদ্যোক্তারাও বিদেশি ফলের চাষ করছেন। এর ফলে বাজারই বলে দেবে কোন ফল আমদানি হবে, কোনটি হবে না।

বিদেশি ফলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় আপেল। এর পরের অবস্থান মাল্টার। এ দুটি ফলের বাইরে কমলা, ডালিম, আঙুর, নাশপাতি ও লেবুজাতীয় ফল আমদানি হয়। সব মিলিয়ে গত অর্থবছরে বিদেশি ফল আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ১৬ হাজার টন। মোট আমদানির ৭৭ শতাংশই হচ্ছে আপেল ও মাল্টা।

২০২০ সালের ডিসেম্বর ও চলতি ২০২১ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের দুটি প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বিশ্বে আপেল আমদানিতে তৃতীয় ও মাল্টায় ষষ্ঠ। তবে মাল্টা খাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বে ১৪তম অবস্থান বাংলাদেশের।

চাহিদার বিবেচনায় চাষ বাড়ছে ফলের

রাজশাহী অঞ্চলে ড্রাগন চাষের চিন্তা এক দশক আগেও চাষিদের মাথায় ছিল না। বেশ কয়েক বছর থেকে ড্রাগন চাষের পরিমাণ বেড়েছে। রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলায় ২০০ হেক্টর জমিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে এই ফল। বিস্ফোরণ আকারে দামী ফসল চাষে আগ্রহী হচ্ছেন চাষিরা।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পিরিজপুর এলাকার মো: ইসমাঈল হোসেন (৪৫)। মহিশালবাড়ী থেকে চারা সংগ্রহ করে বছর তিনেক সময় ধরে চাষ করছেন ড্রাগন। গত ২ বছরে ৩ বিঘা জমি থেকে ২৫ লাখ টাকার ড্রাগন বিক্রি করেছেন বলে দাবি এই চাষির। নতুন করে আরো ১৫ বিঘা জমিতে নতুন চারা লাগিয়েছেন।

এই চাষি এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে জানান, ঢালু বরেন্দ্র বেলে-দোয়াঁশ মাটিতে ড্রাগনের ভালো ফলন হচ্ছে। সারিসারি সিমেন্টের খুঁটি জমিতে দেখা যাচ্ছে। মানুষ লাভের আশায় ড্রাগন চাষে ঝুঁকছেন। প্রতি বিঘাতে খরচ ৩ লাখ টাকা কিন্তু ফল আসলে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা পকেটে আসবে।

এগ্রিকেয়ার২৪.কমের আরোও নিউজ পড়তে পারেন:

কৃত্রিমভাবে দিনের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করে সারা বছর ড্রাগন ফল চাষ পদ্ধতি

ড্রাগন চাষে রাসেলের বছরে লাভ ৬ লাখ টাকা

বিনামূল্যে যতখুশি কমলা-মাল্টা খাওয়ার দাওয়াত

চায়না-থ্রি কমলা চাষে সফল প্রবাসফেরত আলমগীর

একই এলাকার ড্রাগন চাষি হাফেজ ইঞ্জিনিয়ার মাসনবী বলেন, ৩ বছর আগে ৩ বিঘা জমিতে ড্রাগন চাষ শুরু করি। এরপর ড্রাগন চাষের জমি পর্যায়ক্রমে বাড়ানোর চেষ্টা করি। ৩ বিঘা জমি ছিল আমার বাবার। চারিদিকে মেহগণি গাছ থাকলেও মাঝখানে ফাঁকা। একজন পরামর্শ দিলো ড্রাগন চাষের। তারপর শুরু। গত ২ বছরে ২৫ লাখ টাকার ড্রাগন ফল বিক্রি হয়েছে। ড্রাগনের জন্য এবার ১২ বিঘা ২০ হাজার টাকা বিঘা হিসেবে লিজ নিয়েছি। আমার মোট জমি ১৫ বিঘা জমি তৈরি করতে যে টাকা খরচ হয়েছে তার আগের ৩ বিঘা জমির ফলন দিয়ে। ১৮ মাসে ফলন দেয়। একবছরে সব টাকা তুলে আগামী বছর যা উৎপাদন হবে সেটি হবে পুরোটাই লাভ।

পাহাড়ের সুমিষ্ট চায়না, দার্জিলিং কমলা উৎপাদিত হয়েছে নাটোর সদর উপজেলার ড্রিম এগ্রো ফার্ম ও নার্সারিতে। দুই বছরে ভালো ফলন পাওয়ায় বিক্রি না করে সবাইকে ফ্রিতে কমলা খাওয়াচ্ছেন তরুণ উদ্যোক্তা মো. আজিজুর রহমান। কমলা চাষের কারণে নার্সারি মালিক আজিজুল এখন ‘কমলা আজিজুল’ নামে পরিচিতি পেয়েছেন আজিজুজের ড্রিম এগ্রো ফার্ম ও নার্সারীতে নাগপুরি কমলা, চায়না থ্রি কমলা, দার্জেলিং কমলা, পাকিস্তানি কমলা, মিশরীয় মাল্টা, ইন্ডিয়ান মেন্ডারিনসহ নয়টি জাতের কমলা ও মাল্টা রয়েছে। কমলা ও মাল্টার প্রায় ৩০০ চারা ভারত থেকে নিয়ে এসে বাগানে রোপন করেছেন তিনি। পরিচর্যার পর ৩ বছরের মাথায় গাছে কমলা ধরে। এখন বিক্রি করছেন বাজারে। ভালো দাম পাওয়ার কারণে চাষিরা উচ্চমূল্যের ফসল চাষ করছেন।

আজিজুল রহমান আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, কেবল পাহাড় নয়; প্রযুক্তি ব্যবহার করে সমতল জমিতেও সুমিষ্ট কমলার চাষ সম্ভব। বিদেশ থেকে কমলা আমদানির দিন শেষ হতে চলেছে। বাণিজ্যিকভাবে বাগান করলে দেশীয় কমলা দিয়ে বাৎসরিক চাহিদা মেটানো সম্ভব।

কৃষি বিভাগের তৎপরতা

বর্তমানে ফুটপাতে বা ভ্যানে বিক্রি হওয়া বিদেশি ফলকে ৯ বছর আগে বিলাসপণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী আপেল, কমলা ও নাশপাতিকে বিলাসপণ্যের তালিকায় রাখা হয়েছিল। ‘বিলাসপণ্যের ব্যবহার কমানো’র যুক্তিতে ফল আমদানির ক্ষেত্রেও আরোপ করা হয় নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক। তাই ফল আমদানিতে এখনো ৮৯ শতাংশের বেশি করভার রয়েছে। তা সত্ত্বেও আমদানি বাড়ছে। অর্থাৎ উচ্চ শুল্ক দিয়ে আমদানি করা ফল খেয়েও সরকারকে রাজস্ব দিচ্ছেন ক্রেতাসাধারণ। এসব দেখে দেশে অপেক্ষাকৃত ধনী চাষিরা চাষ শুরু করছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে তাজা ফল আমদানি হয়েছে ৩০ কোটি ডলার বা ২ হাজার ৫৫০ কোটি টাকার (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে)। চীন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, মিসর, ভুটান ও ব্রাজিল থেকেই এসেছে মোট আমদানির ৯৪ শতাংশ। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশ থেকে সীমিত পরিমাণে ফল আসছে। দেশে খুচরা পর্যায়ে বছরে ফলের বাজারের আকার প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এগ্রিকেয়ার২৪.কমের আরোও নিউজ পড়তে পারেন:

আড়াইশ গাছে ২৫ লাখ টাকার কমলা!

সুকেজ চন্দ্রের মাল্টা চাষে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন

মাল্টা চাষে সফল সৌদি ফেরত হাবিবুর

দার্জিলিং কমলা চাষে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মাজাহারুল

রাজস্ব বোর্ড ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী করোনার কারণে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ফল আমদানি সামান্য কমেছে। গত পাঁচ অর্থবছরের হিসাবে গড়ে ৬ শতাংশ হারে বাড়ছে বিদেশি ফল আমদানি। তবে দেশীয় ফলের উৎপাদন বাড়ছে ১০-১২ শতাংশ হারে।

‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক মেহেদী মাসুদ বলেন, দেশে বর্তমানে ১০-১২টি বিদেশি ফলের চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে কমলা, মাল্টা, ড্রাগন ও ডালিম—এই চার ফলের উৎপাদন যেভাবে বাড়ছে, তাতে পর্যায়ক্রমে এগুলোও একসময় আমদানি করতে হবে না। তিনি আরও বলেন, এখন সীমিত পরিমাণে ড্রাগন, পেয়ারা, কাঁঠাল, লটকন, আম ও জলপাই রপ্তানি হচ্ছে।

জেলা পর্যায়ে গুরুত্ব দিয়েছে কৃষি বিভাগ

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় এসব ফসল চাষ বাড়ছে। এ বিষয়ে রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো: মোজদার হোসেন বলেন, ফলের চাষ দিন দিন বাড়ছে। ফল উৎপাদনের দিকে নজর দিয়েছে সরকার। বিদেশ থেকে যে পরিমাণ ফল আমদানি করা হয় তা যদি দেশে উৎপাদন সম্ভব হয় তাহলে দেশের টাকা দেশে থাকবে। দেশের কৃষকরা লাভবান হবে। কৃষিতে আধুনিকীরণ প্রক্রিয়ায় সরকার প্রচুর অর্থব্যয় করছে যেন দেশ স্মার্ট কৃষির দেশ হিসেবে গড়ে উঠে।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ